বাবার সঙ্গে আমি কোনো জয়েন্ট একাউন্ট করেছি বলে আমার মনে পড়ে না।
আমি নিজে এসে তোমার কাছ থেকে কিছু সিগনেচার নিয়ে গিয়েছিলাম। তোমাকে জয়েন্ট একাউন্ট খোলার কথা কিছু বলা হয় নি।
ও আচ্ছা।
স্যার উইল করে তাঁর সমস্ত ব্যবসার মালিক তোমাকে করে গেছেন। উইলের কপি উকিলের কাছে আছে। আমাদের অফিসেও আছে। এর মধ্যে স্যারের একটা ব্যবসা আছে খুবই সেনসিটিভ। এই বিষয়ে তোমাকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সম্ভব হলে আজই নিতে হবে।
কী সিদ্ধান্ত?
ব্যবসাটা তুমি রাখবে না ছেড়ে দেবে। যদি বল— এই ব্যবসা তুমি রাখবে না— আমি চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ব্যবসা বিক্রি করে দেব। ব্যবসা হাত বদল হয়ে যাবে। কেউ কিছু জানবেও না। আমরাও ক্ষতিগ্রস্থ হব না।
শুভ্ৰ বিস্মিত হয়ে বলল, কী ব্যবসা?
ছালেহ ভুরু কুঁচকে সিগারেট ধরালেন। তাঁর মুখের বিরক্তির ভাব আরো প্রবল হয়েছে। অতিরিক্ত রকমের বিরক্ত হলে মানুষের মুখে থুথু জমে। ভদ্রলোকের মুখে থু থু জমেছে। তিনি জানালার কাছে গিয়ে থু থু ফেলে আবার এসে চেয়ারে বসলেন। সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বললেন— খারাপ পাড়ার তিনটা বাড়ি স্যারের। তিনটা বাড়িতে বাহান্নজন মেয়ে থাকে। এটা তোমাদের তিন পুরুষের ব্যবসা। তোমার দাদাজান তার বাবার কাছ থেকে এই বাড়ি তিনটা পেয়েছিলেন। এখন উত্তরাধিকার বলে তুমি। ভেবে দেখ— এই ব্যবসা তুমি রাখবে কি-না!
শুভ্ৰ তাকিয়ে আছে। তার চোখে পলক পড়ছে না। ম্যানেজার সাহেব বললেন, আমি কী বলছি তুমি কি বুঝতে পারছ?
পারছি।
একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাকে জানাও। দুটা পার্টির সঙ্গে আমার কথাবার্তা হয়ে আছে।
আমার মা কি বাবার এই ব্যবসার কথা জানেন?
অবশ্যই জানেন।
বাড়ির ভেতর থেকে কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।
অনেক লোকজন চলে এসেছে এখন কান্নাকাটি হবেই। ছালেহ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে শুভ্ৰকে দেখছেন। ময়না পাখি হঠাৎ বলে উঠিল— শুভ্ৰ ভাত খাইছো?
এই কথাটা পাখি সব সময় তিনবার করে বলে- আজ বলল একবার।
ছালেহ হাতের সিগারেট ফেলে দিয়ে আরেকটা ধরাতে ধরাতে বললেন, আজ তোমার বড় দুঃখের দিন। এই দিনে ব্যবসার কথা বলা উচিত না। আমি নিরুপায় হয়ে বললাম। খারাপ পাড়ার ব্যবসার বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তুমি যদি আমার কোনো পরামর্শ চাও, পরামর্শ দিতে পারি।
শুভ্ৰ শান্ত গলায় বলল, আমি আপনার কাছ থেকে কোনো পরামর্শ চাচ্ছি না।
শুভ্ৰ চেয়ারে বসে আছে। তার চোখে চশমা নেই। চশমা খুলে সে দৃশ্যমান জগত থেকে নিজেকে আলাদা করেছে। কিন্তু পৃথিবী শব্দময়। শব্দময় পৃথিবী থেকে নিজেকে আলাদা করার সহজ কোনো উপায় নেই। সব কিছু থেকেই নিজেকে আলাদা করে ফেলার তীব্ৰ ইচ্ছায় শুভ্রের শরীর কাঁপছে। ভয়ঙ্কর কিছু করতে হচ্ছে। ভয়ঙ্কর কিছু।
বারান্দায় কোরানপাঠ হচ্ছে! যে ক্বারী সাহেব কোরান পাঠ করছেন তার গলা অসম্ভব সুরেলা। একটু পর পর সেই বিখ্যাত বাক্যটি ফিরে ফিরে আসছে— ফাবিয়ায়ে আল ওয়া রাব্বিকুমা তুকাজজিবান। শুভ্রর ইচ্ছা করছে কোরানপাঠের মাঝখানে সে উপস্থিত হয়। ক্বারী সাহেবকে বলে— ভাই আপনি হয়তো জানেন না আমার বাবা নোংরা মানুষ ছিলেন। তাঁর মঙ্গলের জন্যে আপনি প্রার্থনা করবেন না।
বন্ধ দরজায় টোকা পড়ছে। শুভ্র বলল, কে? ওপাশ থেকে বিনু ক্ষীণ গলায় বলল, আমি।
কি চাও?
চাচী আমাকে পাঠিয়েছেন। আপনি কী করছেন দেখে যাবার জন্যে।
আমি কিছুই করছি না। চুপচাপ চেয়ারে বসে আছি। বিনু তুমি কী মাকে একটু পাঠাবে আমার কাছে।
জ্বি আচ্ছা।
শুভ্ৰ টেবিল থেকে চশমা নিয়ে চোখে দিল। মাকে সে কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করবে। সেই সময় মার চেহারাটা কেমন বদলায় তার দেখার ইচ্ছা। না বেশি প্রশ্ন না। মোটে তিনটা প্রশ্ন।
প্রথম প্রশ্ন, মা তুমি বাবার এই ভয়ঙ্কর ব্যবসার কথা জানতে। তুমি তাকে এর থেকে মুক্ত করার চেষ্টা কেন কর নি।
মার উত্তর হবে- চেষ্টা করেছিলাম। পারি নি। ওদের কয়েক পুরুষের ব্যবসা।
তখন দ্বিতীয় প্রশ্ন করা হবে- যখন পারলে না। তখন বাবাকে ছেড়ে আমাকে নিয়ে চলে গেলে না কেন?
এর সম্ভাব্য উত্তর হবে, আমার কোথাও যাবার জায়গা ছিলো না।
তখন শেষ প্রশ্ন। মা আমাকে কিছু জানাও নি কেন? তুমি কি মনে মনে চাচ্ছিলে বাবার পর তার এই ব্যবসা আমি দেখব? এখন বল আমি যদি তাই ঠিক করি তুমি কী করবে? পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া ঐ ভয়ঙ্কর বাড়িগুলিতে আমি যদি রাত্রি যাপন করা শুরু করি তোমার কেমন লাগবে?
জাহানারা শুভ্রর ঘরে ঢুকলেন। কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন বাবারে তুই এমন ভাবে বসে আছিস কেন? একদিনে তোর চোখ মুখ কেমন হয়ে গেছে। তুই শুয়ে থাক। আয় তোর মাথায় হাত বুলিয়ে দেই।
শুভ্ৰ চোখ থেকে চশমা নামিয়ে ফেলল।
জাহানারা বললেন, তুই এমন করে তাকিয়ে আছিস কেন? তোকে পাগল পাগল লাগছে।
শুভ্ৰ বলল, মা আমি ঠিক আছি। তুমি এখন যাও। আমি কিছুক্ষণ একলা বসে থাকব। বলেই শুভ্র তার সুন্দর হাসিটা হাসল।
লাল রঙের গাড়িটার পেছনের সিটে
এখন আমি আমাদের লাল রঙের গাড়িটার পেছনের সিটে বসে আছি। আমার মা আমার হাত ধরে আছেন। যেহেতু আমার কিছুই করার নেই। আমি মনে মনে ডায়েরি লিখছি। এই কাজটা আমি খুব ভাল করি। আমি কল্পনা করে নেই আমার সামনে মস্ত বড় সাদা একটা কাগজ। সেই কাগজে। আমি পেন্সিল দিয়ে লিখছি। পেন্সিলের রঙ নীল। তার লেখাও নীল। লেখা পছন্দ না হলে কাটাকুটিও করছি। কিছু লেখা আবার ইরেজার দিয়ে মুছে নতুন করে লিখছি। সব বয়স্ক মানুষের কিছু কিছু ছেলেমানুষী খেলা থাকে। এও আমার এক ধরনের খেলা।