খাটো করে ঐ মেয়েটি নাকি; লাল ওড়না?
হুঁ।
ভালোই হয়েছে। দেখ তোরা দু জনে, আমায় ছেড়ে দে।
না-না, আসেন এই পোস্টাব বোর্ডটার আড়ালে চলে যাই। না দেখলেই চলে যাবে।
তুই যা আড়ালে, আমাকে তে। স্মার চেনে না।
আহা, আসেন না। কোন দিকে গেছে?
দোতলায় খুঁজতে গেছে হয়তো।
কেমন গাধা মেয়ে দেখেছেন? সাড়ে বারোটায় আসতে বলেছি, এসেছে দেড়টায়।
ছবিটা সত্যি ভালো। কিছুক্ষণের মধ্যেই জমে গেলাম। তবে ইটালিয়ান ছবি যেমন হয়–করুণ রসের ছড়াছড়ি। ছবির সুপুরুষ ছেলেটি বিয়ে করেছে তার প্রেমিকার বড় রোনকে। খবর পেয়ে প্রেমিকা বিছানায় শুয়ে ফুলে ফুলে কাঁদছে। সেটাই দেখাচ্ছে অনেকক্ষণ ধরে। হঠাৎ সচকিত হয়ে দেখি কিটকি নিজেই মুখে আধখানা রুমাল গুঁজে কান্নার দুরন্ত বেগ সামলাচ্ছে। চোখের পানিতে চিকচিক করছে গাল। পাশে বসা এক গোবেচারা তরুণ পর্দা ছেড়ে কিটকিকেই দেখছে অবাক হয়ে। আমি বললাম, কি রে কিটকি, কী ব্যাপার?
কিছু না।
আয় আয়, ছবি দেখতে হবে না। কী মুশকিল। কান্নার কী হল! তোর তো কিছু হয় নি।
কিটকির হাত ধরে হল থেকে বেরিয়ে এলাম। আলোয় এসেই লজ্জা পেয়ে গেল সে।
তুই একটা পাগল।
বলেছে আপনাকে।
আর একটা বাচ্চা খুকি।
আর আপনি একটা বুড়ো।
তুই ভারি ভালো মেয়ে কিটকি। তোর কান্না দেখে আমার এত ভালো লেগেছে।
ভালো হবে না বলছি।
আইসক্রীম খাবি কিটকি?
ন্-না।
না-না, খেতেই হবে। আয়, তুই সিনেমা দেখালি–আমি আইসক্রিম খাওয়াই।
দেখলেন তো কুল্লে সিকিখানা সিনেমা।
আচ্ছা, তুই সিকিখানাই খাস।
কিটকি সুন্দর করে হাসল। সবুজ রুমালে নাক ঘষতে ঘষতে বলল, ছবিটা বড় ভালো, তাই না?
হ্যাঁ।
ইস, সবটা যদি দেখতাম!
গরমে মন্দ লাগল না আইসক্রীম। বড়ো কথা, পরিবেশটি ভালো। সুন্দর করে সাজান টেবিলে সাদা টেবিল-ক্লথ। বয়গুলি কেতাদুরস্ত। অসময় বলেই ভিড় নেই। কিটকি তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলল, চলুন উঠি।
বস আরেকটু, আইসক্ৰীম আরো একটা নে।
ছেলেমানুষ পেয়েছেন আমাকে, না?
সবুজ রুমাল বের করে নাক ঘষল কিটকি?
আমার ভীষণ নাক ঘামে, খুব বাজে।
না, খুব ভালো, যাদের নাক ঘামে তারা–
জানি জানি, বলতে হবে না। যত সব মিথ্যে কথা। আপনি বিশ্বাস করেন?
না।
আমিও না। আচ্ছা, যে-সব মেয়েদের গালে টোল পড়ে, তাদের হ্যাসব্যাণ্ড নাকি খুব কম বয়সে মারা যায়?
কই, তোর তো টোল পড়ে না? নাকি পড়ে? হাসি দে একটা।
আহা, আমার জন্যে বলছি না। আপনি ভারি বাজে।
বাসায় যাবি কিটকি? চল যাই।
না, আজ থাক। আরেক দিন যাব।
শুক্রবারে আয়।
শুক্রবারে কলেজ খোলা যে, আচ্ছা, সন্ধ্যান্ধেলা আসব।
রাতে থাকবি তো?
উঁহু।
কিটকি রিকশায় উঠে হাত নাড়ল।
রোদের তেজ কমে আসছে। চারটে বেজে গেছে প্ৰায়। প্রচুর ঘেমেছি। বাসায় গিয়েই একটি দীর্ঘ গোসল সারব। অবেলায় ভাত আর খাব না। চা-টা খেয়ে দীর্ঘ ঘুম দেব। রাবেয়া কদিন ধরেই সিনেমা দেখার জন্যে ঘ্যানর ঘ্যানর করছে। তাকে নিয়ে এক দিন দেখলে হয় ইয়েলো স্কাই।
বাসায় এসে দেখি, গেটে তালা ঝুলছে। তালার সঙ্গে আটকান ছোট্ট চিরকুট, খোকা, সবাই মিলে ছোটখালার বাসায় বেড়াতে গিয়েছি। সন্ধ্যার আগে ফিরব না। তুইও এসে পড়।–রাবেয়া।
ক্লান্তি লাগছিল খুব, কোথাও গিয়ে চা-টা খেলে হত।
এই চিঠিটি সম্ভবত তোমাকেই লেখা?
তাকিয়ে দেখি, বেশ লম্বা নিখুঁত সাহেবি পোশাকে এক ভদ্রলোক আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। কপালের দু পাশের চুলে পাক ধরলেও এখনো বেশ শক্ত–সমর্থ চেহারা।
তুমি বলেছি বলে কিছু মনে পর নি তো, ছেলের বয়সী তুমি।
না-না, কিছু মনে করি নি। আমি। আপনাকে ঠিক চিনতে পারছি না।
চিনবে কী করে, আমি তো পরিচিত কেউ নই। রাবেয়া বলে এই বাড়িতে একটি মেয়ে আছে না?
জ্বি, আমার বোন।
ছোটবেলায় সে যখন স্কুলে পড়ত, তখন তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। তাকে দেখলেই আমি গাড়িতে করে লিফট্ দিতাম।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, বড়ো ভালো মেয়ে। অনেক দিন দেশের বাইরে ছিলাম। কিছুদিন হল এসেছি, ভাবলাম মেয়েটিকে দেখে যাই। এসে দেখি তালাবন্ধ। তালার সঙ্গের চিঠিখানা পড়ে দেয়াশলাই কিনতে গিয়েছি, আর তুমি এসেছি।
আপনাকে বসাই কোথায়-আসেন, চা খান এক কাপ।
না। আমার ডায়াবেটিস, চা থাক। তুমি এই মেয়েটিকে এই চকোলেটগুলি দিয়ে দিও, আচ্ছা?
ভদ্রলোক কালো ব্যাগ খুলে চকোলেট বের করতে লাগলেন।
বিদেশে থাকাকালীন প্রায়ই মনে হত, মেয়েটির বিয়ে হয়ে যায় নি তো? হলে কোথায় হল?
না, বিয়ে হয় নি এখনো।
আচ্ছা তাহলে যাই, কেমন?
রাবেয়া বেশ মেয়ে তো! পথের লোকজনদের সঙ্গে ছোট বয়সেই কেমন খাতির জমিয়েছে। এমন খাতির যে একেবারে বিদেশ থেকে চকোলেট এনেছেন তিনি। চকোলেট-খাওয়া মেয়েটি এত বড়ো হয়েছে জানলে আর চকোলেট আনতেন না নিশ্চয়ই। রাবেয়ার এমন আরো কয়েক জন বন্ধু আছে। এক জন ছিল আবুর মা। কী যে ভালোবাসত রাবেয়াকে! রোজ এক বার খোঁজ নেওয়া চাই। রাবেয়ার যে-বার অসুখ হল, টাইফয়েড, আবুর মা তার ঘরসংসার নিয়ে আমাদের বারান্দায় উঠে এল। পনের দিনের মতো ছিল অসুখ, সেই কদিন বুড়ি এখানেই ছিল। মা ভারি বিরক্ত হয়েছিলেন। মেয়ের অমঙ্গল হবে ভেবে তাড়িয়েও দিতে পারেন নি। হঠাৎ একদিন আবুর মা আসা বন্ধ করে দিল। হয়তো চলে গিয়েছিল অন্য কোথাও, কিংবা মারা-টারা গিয়েছে গাড়িাচাপা পড়ে। রাবেয়াকে ঠাট্টা করে সবাই আবুর মার সখী ডাকত। বাবা ডাকতেন আবুর নানী। রাবেয়া রাগত না মোটেই। আবুর মার সঙ্গে রাবেয়া হেসে হেসে কথা কইছে, ছবির মতো ভাসে চোখে।