খোকা, তোর কী ধারণা? আওয়ামী লীগ পপুলারিটি হারাবে?
আমার? না, আমার কোনো ধারণা নেই।
ভালো করে পেপার পড়া চাই, না পড়লে কি কিছু বোঝা যায়? রাজনীতি বুঝতে হলে চোখ-কান খোলা রাখা চাই, বুঝলি? কি, বিশ্বাস হল না, না?
হবে না কেন? বিশ্বাস যদি না হয়, কাগজ-কলম নিয়ে আয়, তিন বৎসর পর পাটির কি অবস্থা হবে লিখে দিই। সীল করে রেখে দে। তিন বৎসর পর অক্ষরের সাথে অক্ষর মিলিয়ে দেখবি।
বাবার রূপান্তর খুব আকস্মিক। আর আকস্মিক বলেই বড়ো চোখে পড়ে। প্রচুর মিথ্যে কথাও বলেন বানিয়ে বানিয়ে। সেদিন যেমন শুনলাম। ওভারশীয়ার কাকুর ছেলের বউয়ের সঙ্গে গল্প করছেন পাশের ঘরে। এ ঘর থেকে সমস্ত শোনা যাচ্ছে, কাউকে যেন বলো না মা, গতকাল রাতে একটা অদ্ভুত ব্যাপার হয়েছে।
কী ব্যাপার চাচাজান?
অনেক রাত তখন। আমি বারান্দায় ইজিচেয়ারে শুয়ে আছি। হঠাৎ ফুলের গন্ধ পেলাম। বকুল ফুলের গন্ধ। অবাক হয়ে চোখ তুলে তাকিয়ে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবার যোগাড়। দেখি কি, খোকার মা হালকা হলুদ রঙের একটা শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছে আমগাছটার নিচে।
বলেন কি চাচা!
হ্যাঁরে মা, মিনিট তিনেক দেখলাম।
রাত কত তখন?
বারোটার মতো হবে। গল্পটি যে সম্পূর্ণই মিথ্যা, এতে কোনো সন্দেহ নেই। গতরাতে আমার এক ফোঁটা ঘুম হয় নি। সারা রাতই আমি বারান্দার ইজিচেয়ারে বসে কাটিয়েছি।
অথচ যে-বাবা কোনোদিন অপ্রয়োজনে সত্য কথাটিও বলেন নি, তিনি কেন এমন অনর্গল মিথ্যা বলে চলেন, ভেবে পাই না।
রাবেয়া এক দিন বলছিল, মা মারা যাবার পর বাবা খুব ফ্রী হয়েছেন।
তার মানে?
মানে আর কি, মনে হয়। বাবা মার সঙ্গে ঠিক মানিয়ে নিতে পারেন নি।
তুই কী সব সময় বাজে বকিস?
আহা এমনি বললাম। কে বলেছে বিশ্বাস করতে?
বিশ্বাস না করলে অবশ্যি চলে, কিন্তু বিশ্বাস না করাই—বা যায় কী করে? কিন্তু মার মতো মেয়ে তেইশ বছর কী করে মুখ বুজে এইখানে কাটিয়ে দিয়েছেন ভেবে পাই না। বাবা মার সঙ্গে হাস্যকর আচরণ করতেন। যেন মনিবের মেয়ের সঙ্গে দিয়ে দেয়া প্রিয় খানসামা এক জন। ভালোবাসার বিয়ে হলে এ রকম হয় না। সেখানে অসামঞ্জস্য হয়, অশান্তি আসে, কিন্তু মূল সুরটি কখনো কেটে যায় না। অথচ যতদূর জানি ভালোবেসেই বিয়ে হয়েছিল তাঁদের। কিছুটা খালা বলেছেন, কিছু বলেছেন বাবা, রাবেয়াও বলেছে কিছু কিছু (সে হয়তো শুনেছে মার কাছ থেকেই)। সব মিলিয়ে এ ধরনের চিত্র কল্পনা করা যায়।
শিরিন সুলতানা নামের উনিশ বছরের একটি মেয়ে সূর্য ওঠার আগে ছাদে বসে হারমোনিয়ামে গলা সাধাত ঘড়ির কাঁটার মতো নিয়মে। সাতটার দিকে গানের মাস্টার শৈলেন পোদার আসতেন গান শেখাতে। তিনি আধাঘণ্টা থাকতেন। এই সমস্ত সময়টা আজহার হোসেন নামের একটা গরিব আশ্রিত ছেলে কান পেতে অপেক্ষা করত। ছাদের চিলেকোঠার ঘরটায়, সেখানেই সে থাকত। এক দিন মেয়েটি কীএকটি গান গাইল যেন, খুব ভালো লাগল ছেলেটির। বেরিয়ে এসে কুণ্ঠিতভাবে বলল, আরেক বার গান না। মাত্র এক বার।
থেকে। লজ্জিত ছেলেটি অপরাধী মুখে আরো দু বছর কাটিয়ে দিল চিলেকোঠার ঘরটায়। এই দু বছরে শিরিন সুলতানার সঙ্গে তার একটি কথাও হয় নি। শুধু দেখা গেল, দু জনে বিয়ে করে দেড় শ টাকা ভাড়ার একটা ঘুপচি ঘরে এসে উঠেছেন।
কী করে এটা সম্ভব হল, তা আমার কাছে একটি রহস্য। রাবেয়ার কাছে জানতে চাইলে সে বলত, আমি জানি, কিন্তু বলব না।
কেন?
এমনি। কী করবি শুনে?
জানতে ইচ্ছে হয় না?
বলব তোকে একদিন। সময় হোক।
সেই সময়ও হয় নি। জানাও যায় নি কিছু। অথচ খুব জানতে ইচ্ছে করে।
ফার্স্ট ইয়ারের ছেলেদের সঙ্গে দুপুর বারোটায় একটা ক্লাস ছিল। একটার দিকে শেষ হল। দুপুরে রিকশা পাওয়ার আশা কম। সব রিকশাওয়ালা একসঙ্গে খেতে যায় কি না কে জানে? অল্প হাঁটতেই ঘামে শার্ট ভিজে ওঠার যোগাড়। ভীষণ রোদ। রাস্তার পিচ গলে স্যাণ্ডেলের সঙ্গে আঠার মতো এটে যাচ্ছিল। ছায়ায় দাঁড়িয়ে রিকশার জন্যে অপেক্ষা করব কি না যখন ভাবছি, তখনি মেয়েলি গলা শোনা গেল, খোকা ভাই, ও খোকা ভাই।
তাকিয়ে দেখি কিটকি। সিনেমা হলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সবাইকে সচকিত করে বেশ জোরেসোরেই ডাকছে। কানে পায়রার ডিমের মতো দুটো লাল পাথর। চুলগুলো লম্বা বেণী হয়ে পিঠে ঝুলছে। কামিজ সালোয়ার সবই কড়া হলদে।-লাল নকশাকাটা। সুন্দর দেখাচ্ছিল, মুখটা লম্বাটে, পাতলা বিস্তৃত ঠোঁট। আমি বললাম, কিরে, তুই সিনেমা দেখবি নাকি?
হুঁ, ইয়েলো স্কাই।
একা এসেছিস?
না, আমার এক বন্ধু আসবে বলেছিল, এখনো আসল না। দেড়টা বেজে গেছে, এখুনি শো শুরু হবে।
টিকিট কেটে ফেলেছিস?
হ্যাঁ।
দে আমার কাছে, বিক্রি করে দি একটা। তুই দেখ একা-একা।
আপনি দেখেন না। আমার সঙ্গে, আপনার তো কোনো কাজ নেই। আসেন না।
আরে, পাগল নাকি? বাসায় গিয়ে গোসল করব, ভাত খাব।
আহা, এক দিন একটু দেরি হলে মরে যাবেন না। একা একা ছবি দেখতে আমার খুব খারাপ লাগে। আসেন না, দেখি। খুব ভালো ছবি। প্লীজ বলুন, হ্যাঁ।
কিটকির কাণ্ড দেখে হেসে ফেলতে হল। বললাম, চল দেখি, ছবি ভালো না এ লে। কিন্তু মাথা ভেঙে ফেলব।
দু জন সিঁড়ি দিয়ে উঠছি দোতলায়, কিটকি হঠাৎ দাঁড়িয়ে বলল, দেখুন তো, কী মুশকিল হল।
আবার কি?
আমার বন্ধুটা এসে পড়েছে। ঐ যে নামছে রিকসা থেকে।