সে তখন খুব ছোট, ছ-সাত বৎসর বয়স হবে। মায়ের সঙ্গে বেড়াতে এসেছে বাসায়। রুনু-বানুর সঙ্গে সারা দুপুর হৈচৈ করে খেলল, তখন মা যখন সবাইকে খেতে ডাকলেন, তখন কী খেয়াল হল কি জানি মাকে গিয়ে বলল, খালা, আমি আপনাকে একটা কথা বলব, কাউকে বলবেন না তো?
না মা, বলব না।
আল্লার কসম বলুন।
আল্লার কসম।
তা হলে মাথা নিচু করুন, আমি কানে কানে বলি।
মা মাথা নিচু করলেন এবং কিটকি ফিসফিস করে বলল, বড়ো হয়ে আমি খোকা ভাইকে বিয়ে করব। আপনি কাড়কে বলবেন না তো?
মা কিটকির কথা রাখেন নি। সঙ্গে সঙ্গে সবাইকে বলে দিয়েছেন। যদিও সুদূর শৈশবের ঘটনা, তবু স্থানে—অস্থানে এই প্রসঙ্গ তুলে বেচারিকে প্রচুর লজ্জা দেওয়া হয়। মা তো কিটকির সঙ্গে দেখা হলে এক বার হলেও বলবেন, আমার বউমেয়েকে কেউ দেখি যত্ব করছে না?
কিটকি তার মায়ের পাশে বসল। সে আজ হলুদ রঙের কামিজ পরেছে, লম্বা বেণীতে মস্ত বড়ো বড়ো দুটি হলুদ ফিতের ফুল। অল্প হাসল কিটকি। আমি বললাম, কি কিটকি, আজ কলেজ নেই?
আছে, যাব না।
কেন?
এমনি। কলেজ ভীষণ বোরিং। তা ছাড়া খালার অসুখ।
থাকবি আজ সারা দিন?
হ্যাঁ। আজ রাতে আপনাকে ভূতের গল্প বলতে হবে।
ভূতের গল্প শুনে কাঁদবি না তো আবার?
ইস, কাঁদব? ছোটবেলায় কবে কেঁদেছিলাম, এখনো সেই কথা।
ছোটবেলা তো তুই আরো কত কি করেছিস।
ভালো হবে না কিন্তু।
বলতে বলতে কিটকি লজ্জায় মাথা নিচু করল। খালা বললেন, আমি হাসপাতালে যাই খোকা। কিটকি, তুই যাবি আমার সঙ্গে?
না মা, আমি থাকি এখানে।
খালা চলে যেতেই রাবেয়া চায়ের টে। হাতে ঢুকল। বেশ মেয়ে রাবেয়া। এর ভেতর সে গোসল সেরে নিয়ে চুল বেঁধেছে। রানা শেষ করেছে, এক দফা চা খাইয়ে আবার চা এনেছে। রাবেয়া হাসতে হাসতে বলল, কি কিটকি? না-না ভিটাকি বেগম, এই ঘরে কী করছ? পূর্বরাগ নাকি? সিনেমার মতো শুরু করলে যে?
যান। আপা, আপনি তো ভারি ইয়ে.মা ডাকলেন তাই।
বেশ বেশ, তা এমন গলদা চিংড়ির মতো লাল হয়ে গেছ যে! গরমে না হৃদয়ের উত্তাপে?
যান। আপা, ভাল্লাগে না।
নিন, নিন, ভিটকি বেগম–চা নিন।
কি সব সময় ভিটকি ডাকেন, জঘন্য লাগে।
কিটকির কি কোনো মানে আছে? তাই ভিটকি ডাকি।
যেন তিটিকির কত মানে আছে।
আছেই তো। ভিটকি হচ্ছে ভেটকি মাছের স্ত্রীলিঙ্গ। অর্থাৎ তুই একটি গভীর জলের ভেটকি ফিশ, বুঝলি?
বেশ, আমি গভীর জলের মাছ। না, চা খাব না।
কাঁদো কাঁদো মুখে উঠে দাঁড়াল কিটকি। কাউকে কিছু বলার অবসর না দিয়ে ঝড়ের মতো বেরিয়ে গেল। রাবেয়া হেসে উঠল হো হো করে। বলল, বড়ো ভালো মেয়ে।
হুঁ।
একটু অহংকার আছে, তবে মনটা ভালো।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, আমার জীষণ ভালো লাগে। আর আমার মনে হয় কি জানিস?
কী মনে হয়?
মনে হয় মেয়েটির শৈশবে তোর দিকে যে টান ছিল, তা যে এখনো আছে তাই নয়।–চাঁদের কলার মতো বাড়ছে!
তোর যত বাজে কথা।
রাবেয়া বলল, মেয়েটির কথা ছেড়ে দিই, তোর যে ষোল আনার উপর দু আনা, আঠারো আনা টান তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কান-টান লাল করে একেবারে টমেটো হয়ে গেছিস, আচ্ছা গাধা তো তুই!
রাবেয়া হাসতে হাসতে ভেঙে পড়ল। রুনু এসে ঢুকল খুব ব্যস্তভাবে, হাতে একটা লুড়ুবোর্ড।
কিরে রুনু?
কিটকি আপার কী হয়েছে?
কেন?
চুপচাপ বসে আছে। আগে বলেছিল লুড়ু খেলবে, এখন বলছে খেলবে না।
রাবেয়া উঁচু গলায় হাসল আবার। রুনুকে বললাম, রুনু, মন্টু কোথায়? মন্টুকে দেখছি না তো।
মন্টু হাসপাতালে গেছে।
হাসপাতালে কার সঙ্গে গেল, খালার সঙ্গে?
না, একাই গেছে। তার নাকি খুব খারাপ লাগছিল। তাই একা একাই গেছে।
কোন হাসপাতালে, চিনবে কী করে?
চিনবে। তার স্কুলের কাছেই।
চা-টা খেয়ে গিয়েছে?
না, খায় নি।
রাবেয়া শুয়ে শুয়ে পা দোলাচ্ছিল; হঠাৎ কি মনে করে উঠে বসিল, খোকা তুই বাজি রাখতে চাস আমার সঙ্গে?
কী নিয়ে বাজি?
মায়ের ছেলে হবে কি মেয়ে হবে, এই নিয়ে।
রাবিশ।
আহ, রাখি না একটা বাজি। তোর কি মনে হয় ছেলে হবে?
আমার কিছু মনে হয় না।
আহ, বল না একটা কিছু।
ছেলে।
আমার মনে হয় মেয়ে। যদি ছেলে হয়, তবে আমি তোকে একটা সিনেমা দেখার পয়সা দেব। আর মেয়ে হলে তুই কী দিবি আমাকে?
কি বাজে বকিস। ভাল্লাগে না। আহা, বল না। কী দিবি? প্লীজ বল।
ক্লাস শেষ হল দেড়টায়।
আতিক ছাড়ল না, টেনে নিয়ে গেল তার বাসায়। একটি মেয়ে নাকি প্রেমপত্র লিখেছে তার কাছে। সত্যি মেয়েটিই লিখেছে, না কোনো ছেলে ফাজলামি করেছে, তাই ভেবে পাচ্ছে না। তার আসল সন্দেহটা আমাকে নিয়ে, আমিই কাউকে দিয়ে লেখাই নি তো। যত বার বলছি, আজ ছেড়ে দাও, আরেক দিন কথা হবে। আমার একটু কাজ আছে। ততই সে চেপে ধরে। উঠতে গেলেই বলে, কী এমন কাজ বল? কী যে কাজ, তা আর বলতে পারি না লজ্জায়। অস্বস্তিতে ছটফট করি। বাসায় ফিরতে ফিরতে বিকেল! আমাকে দেখেই ওভারশীয়ার কাকু দৌড়ে এলেন, খোকা, তোমার মারি অবস্থা বেশি ভালো নয়। সবাই হাসপাতালে গেছে। তুমি কোথায় ছিলে? যাও, তাড়াতাড়ি চলে যাও! রিক্সাভাড়া আছে?
আমার পা কাঁপতে লাগল। আচ্ছন্নের মতো রিক্সায় উঠলাম। সমস্ত শরীর টলমল করছে।
কালোমতো একটি মেয়ে কাঁদছে। কী হয়েছে তার কে জানে। রাবেয়া বাবার হাত ধরে রেখেছে। রুনু-খুনুকে দেখছি না। বাচ্চা বোনটা কাঁদছে ট্যাট্যা করে। খালা কোলে করে আছেন তাকে? খালা বললেন, দেখ খোকা, কি সুন্দর ফুলের মতো বোন হয়েছে।