বাবা চাদর গায়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। এত রাতে রিক্সাটিক্সা কিছু পাওয়া যাবে না, হেঁটে হেঁটে যেতে হবে। আমি ইজিচেয়ারে চুপচাপ বসে রইলাম। যে শিশুটি জন্মাবে, সে এত আয়োজন, এত প্রতীক্ষ্ণ ও যন্ত্রণার কিছুই জানছে না, এই জাতীয় চিন্তা হতে লাগল। অন্ধকার মাতৃগর্ভের কোনো স্মৃতি কারোর মনে থাকে না। যদি থাকত, তবে কেমন হত সে-স্মৃতি কে জানে। জন্মের সমস্ত ব্যাপারটাই বড়ো নোংরা।
রাবেয়া এসে দাঁড়াল আমার কাছে। নিচু গলায় বলল, খোকা, বাবা কি হাসপাতালে গেছেন?
হ্যাঁ।
বাবা খুব ভয় পেয়েছেন, নারে?
হুঁ, পেয়েছেন।
আমারো ভয় লাগছে খোকা।
ভয় কিসের?
আমি কিছুতেই বিয়ে করব না, দেখিস তুই। মাগো কী কষ্ট!
মায়ের কাছে গিয়েছিলি রাবেয়া?
হ্যাঁ!
মা কী করছে?
চিৎকার করছেন না। চিৎকার করার শক্তি নেই। খুব কষ্ট পাচ্ছেন।
কী বাজে ব্যাপার।
হুঁ।
মাসি কী করছে?
ঘুমাচ্ছে। বাজনার মতো নাক ডাকছে। মেয়েমানুহ্মেব নাক ডাকা কী বিশ্ৰী। বাঁশির সরু আওয়াজের মতো তালে তালে বাজছে। ঘেন্না লাগে।
মসজিদ থেকে ফজরের আজান হল, ভোর হয়ে আসছে। অ্যাম্বুলেন্স এল ছটার দিকে। ড্রাইভারটা মুশকো জোয়ান। সঙ্গের হেল্লার দুটিরও গুণ্ডার মতো চেহারা। ২ৈচৈ করে স্ট্রেচার বের করল তারা! সাত-সকালেই অনেক লোকজন জড়ো হয়ে গেল। পাড়ার মেয়েদের প্রায় সবাই এসেছে। উকিল সাহেবের বউ আমাকে ইশারায় ডাকলেন, খোকা, তোর মোর অবস্থা নাকি খুব খারাপ? হেড ক্লার্কের বউ বললেন।
না, তেমনি কিছু নয়। দেখে আসুন না গিয়ে।
এই যাচ্ছি বলে তিনি অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরটা দেখতে চেষ্টা করতে লাগলেন। হেড ক্লার্কের বউও এসেছেন, তাল সঙ্গে একটি সুন্দর মতো মেয়ে। কমবয়সী। কয়েক জন ছেলেমেয়ে দেখি হৃষ্টচিত্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মন্টু ভীষণ ভয় পেয়েছে, আমার একটা হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। মাঝে মাঝে সে যে কাঁপছে, তা বুঝতে পারছি। রুনু আর ঝুনুকে দেখছি না। রাবেয়া উঠোনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। একা।
মন্টু বলল, দাদা, তোমাকে ডাকছে।
কে?
ওভারশীয়ার কাকু।
মন্টুর হাত ধরে ওপাশে গেলাম। হয়তো হাজারো কথা জিজ্ঞেস করবেন। পুরুষ মানুষের মেয়েলি কৌতূহলে বড়ো খারাপ লাগে। ওভারশীয়ার কাকু খালি পায়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
আমাকে দেখে বললেন, খোকা, তোমাকে একটু ডাকছিলাম।
কী জন্যে চাচা?
না, মানে তেমন কিছু নয়, ঘুম থেকে উঠেই অ্যাম্বুলেন্স দেখে…..মানে। ইয়ে…… ধর তো খোকা। মাসের শেষ, কতরকম দরকার হয়, লজ্জা করো না সোনা, রাখি।
কথা বলবার অবসর না দিয়ে চাচা সরে গেলেন। ঐদিকটায় হৈচৈ হচ্ছে। ষ্টেচারে করে মাকে তুলছে গাড়িতে, ছুটে গেলাম।
বাবা, সঙ্গে কে যাচ্ছে?
আমি আর তোর সুহাসিনী মাসি।
রাবেয়াকে নিয়ে যান।
না না, ও ছেলেমানুষ। খোকা, তোর ছোটখালাকে খবর দিস।
গাড়ি স্টার্ট নিতেই বাবা আবার ডাকলেন, খোকা, ও খোকা, তোর মা ডাকছে, আয় একটু।
গাড়ির ভেতর আবছা অন্ধকার। গলা পর্যন্ত চাদর জড়িয়ে মা পড়ে আছেন। সারা শরীর কেঁপে উঠছে এক-এক বার। মা নরম স্বরে বললেন, খোকা, আয় এদিকে।
অস্পষ্ট আলোয় চোখে পড়ল। যন্ত্রণায় তাঁর ঠোঁট কেঁপে কেঁপে উঠছে। অদ্ভুত ফর্সা মুখের অদৃশ্য নীল শিরা কালো হয়ে ফুলে উঠছে। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে সারা মুখে।
মা, কী জন্যে ডেকেছেন? কী?
মা কোনো কথা বললেন না। বাবা বললেন, দেরি হয়ে যাচ্ছে, খোকা তুই নেমে যা।
আমিও সঙ্গে যাই বাবা?
না-না, তুই থাক। বাসায় ওরা একা। নেমে যা, নেমে যা।
মাসি গলা বাড়িয়ে বললেন, পানের কীেটা ফেলে এসেছি, কেউ আসে তো সঙ্গে দিয়ে দিও।
গাড়ি ছেড়ে দিল। মন্টু গাড়ির পেছনে পেছনে বড়ো রাস্তা পর্যন্ত গিয়ে ফোঁপাতে ফোঁপাতে ফিরে এল। রুনু-ঝনুকে নিয়ে আমি বসে রইলাম বারান্দায়। জন্ম বড়ো বাজে ব্যাপার। মৃত্যুর চেয়েও করুণ।
বুকের উপর চেপে থাকা বিষন্নতা দেখতে দেখতে কেটে গেল। আবহাওয়া তরল হয়ে এল ঘণ্টাখানেকের মধ্যে। ছোট খালা এলেন নয়টায়। তাঁর মস্ত কালো রঙের গাড়িতে করে, সঙ্গে মেয়ে কিটকি। রাবেয়া ঢাউস এক কেটলি চায়ের পানি চড়িয়ে দিল। রুনু ঝুনু স্কুলে যেতে হবে না। শুনে আনন্দে লাফাতে লাগল।
সারা রাত নিঘুম থাকায় মাথা ব্যথা করছিল। চুপচাপ শুয়ে রইলাম। ইউনিভার্সিটিতে এক দফা যেতে হবে। স্যার কাল খোঁজ করেছিলেন, পান নি। আতিক কি জন্যে যেন তার বাসায় যেতে বলেছে। খুব নাকি জরুরী। চার্লি চ্যাপলিনের দি কিড ছবিটি চলছে গুলিস্তানে। আজ দেখব কাল দেখব করে দেখা হয় নি। দু দিনের ভেতর দেখতে হবে? সামনের হস্তায্য কী একটা বাজে ছবি যেন।
কিরে খোকা, শুয়ে?
মৃদু সেন্টের গন্ধ ছড়িয়ে খালা ঢুকলেন। খালার সঙ্গে মায়ের চেহারার খুব মিল। তবে খালা মোটাসোটা, মা ভীষণ রোগা। খালা পাশের চেয়ারে বসলেন, জ্বর নাকি রে?
জ্বি না, এই শুয়েছি। একটু।
দেখি?
খালা মাথায় হাত রাখলেন।
না, মোটেও জ্বর নেই। ডাক্তারের বউ হাফ-ডাক্তার হয় জান তো?
জানি। জ্বরটির নয়, এমনি শুয়ে আছি।
খারাপ লাগছে? তা তো লাগবেই। বুড়ো বয়সে মায়েদেব যদি মেটারনিটিতে যেতে হয়।
আমি চুপ করে রইলাম। দরজার আড়াল থেকে কিটকি উঁকি দিল। খালা ডাকলেন, আয় ভেতরে।
কিটকি লজ্জিতভাবে ঢুকল। যখন অন্য কেউ থাকে না তখন আমার সঙ্গে কিটকির ব্যবহার খুব সহজ ও আন্তরিক। বাইরের কেউ থাকলেই কিটকি সংকোচ ও লজ্জায় চোখ তুলে তাকায় না। শৈশবের একটি ছোট্ট ঘটনা থেকেই কিটকির এমন হয়েছে।