রাবেয়া আমার পাঁচ বৎসরের বড়ো। এই বয়সে মেয়েরা খুব বিয়ের কথা ভাবে। তাদের অন্তরঙ্গ সখীদের সাথে বিয়ে নিয়ে হাসাহাসি করে। রাবেয়ার একটি বন্ধুও নেই। আমিই তার একমাত্র বন্ধু। সুহাসিনী মাসির সেই কথাটি হয়তো এই জন্যেই বলেছিল আমাকে। আর আমি এমন গাধা, তাকে উন্টো লজ্জা দিয়ে ফেললাম। মেয়েরা লজ্জা পেলে এত বেশি অপ্রস্তুত হয় যে, যে লজ্জা দিয়েছে তার অস্বস্তির সীমা থাকে না।
ঘরে খুব হৈহৈ করে বেড়ালেও রাবেয়া ভীষণরকম লাজুক। কলেজে যাওয়া বন্ধ করার ব্যাপারটিই ধরা যাক। তিন বছর আগে হঠাৎ এক দিন এসে বলল, বাবা, আমি আর কলেজ করব না।
বাবা অবাক হয়ে বললেন, কেন মা?
এমনি।
মা বললেন, রাবেয়া, তোমাকে কি কেউ কিছু বলেছে?
না মা, কেউ কিছু বলে নি।
কোনো চিঠিফিটি দিয়েছে নাকি কোনো ছেলে?
না মা। আমাকে চিঠি দেবে কেন?
তবে কলেজে যাবে না কেন?
এমনি।
না, এমনি না। বল তোমার কী হয়েছে?
রাবেয়া হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলল, মা, ছেলেরা আমাকে মা কালী বলে ডাকে।
আমাদের ভেতর রাবেয়াই শুধু মার রং পায় নি। যতটুকু কালো হলে মায়েরা মেয়েদের শ্যামলা বলেন, রাবেয়া তার চেয়েও কালো। কিন্তু ছেলেরা শুধু গায়ের রংটাই দেখল?
ও ছেলে।
তাকিয়ে দেখি সুহাসিনী মাসি। ধবধব করছে গায়ের রং, ফোলা ফোলা চোখে এক বেমানান চশমা। আমি উঠে দাঁড়ালাম।
খামাখা তোমার বাবা আমার ঘুম ভাঙিয়ে এনেছে, এখনো অনেক দেরি। নটার আগে নয়।
আমি চুপ করে রইলাম। সুহাসিনী মাসি বললেন, মেয়েটি কই? লম্বামতো মেয়েটি?
আসবে এক্ষণি, কেন?
এক কাপ চা করে দিতে বলতাম।–এই যে, ও খুকি, মাসিকে চা করে দাও না এক কাপ।
রাবেয়া হাসিমুখে বলল, দিই, আপনি বসবেন এখানে?
না, আমি একটু শোব ভেতরের ইজিচেয়ারে।
রাবেয়া তাকাল আমার চোখে চোখে, তোর লাগবে নাকি এক কাপ?
দে।
তাহলে পাঁচ কাপ দি। বাবাকে এক কাপ, আমার নিজের দু কাপ।
রাবেয়া চায়ের সরঞ্জাম সাজাতে লাগল। অভ্যস্ত নিপুণ হাত, দেখতে ভালো লাগে। আমি বললাম, মাসির বয়স কত রে?
অনেক। আমি ছাড়া সবাই তো তার হাতে। দেখলে মনে হয় না, তাই না?
হুঁ। মার ব্যথাটা একটু কম মনে হয়।
ছ বার মা এমন কষ্ট পেলেন। তোরা তো সুখে আছিস, কষ্ট যা তা তো মেয়েদেরই। পেটে ছেলে-মেয়ে আসা মানেই এক পা কবরে রাখা।
আমি বললাম, কষ্টটা যদি পুরুষরাও পেত, তাহলে তুই খুশি হতি?
জানি না।
বলেই রাবেয়া হঠাৎ কী মনে করে হাসতে লাগল। হাসির উচ্ছাসে পেয়ালার দুধ গেল উন্টে, অচল খসে পড়ল মেঝেয়।
অবাক হয়ে বললাম, হাসির কী হয়েছে? এত হাসছিস কেন?
একটা গল্প মনে পড়ছে, তাই হাসছি।
কী গল্প?
বাজে গল্প, তবে খুব মজার। শুনলে তুই নিজেও হাসবি। শুনবি?
বল।
একদল মেয়ে আল্লাহর কাছে নালিশ করল। তাদের বক্তব্য ছেলেমেয়ে হওয়ার ব্যথাটা শুধু মেয়েদেরই হবে কেন? এবার থেকে ছেলেদেরও হতে হবে, ব্যথার ভাগও সমান সমান। আল্লাহ বললেন, ঠিক আছে, তাই হবে। তারপর হল কি শোন। মেয়েদের এই দলটির যিনি প্রেসিডেন্ট ছিলেন তাঁর ব্যথা শুরু হল। কিন্তু কি আশ্চর্য স্বামী বেচারা দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন, কোনো ব্যথা-ফ্যতা নেই। এদিকে তাদের গাড়ির ড্রাইভার ছুটির দরখাস্ত করেছে, তার নাকি হঠাৎ ভীষণ ব্যথা শুরু হয়েছে পেটে।
তারপর?
তারপর আবার কি? মেয়েরা বলল, আল্লাহ তোমার পায়ে পড়ি। ব্যথার ভাগাভাগি আর চাই না। আমাদের কষ্ট আমাদেরই থােক। তুই হাসলি না একটুও, আগে শুনেছিস নাকি?
না।
তবে?
নোংরা গল্প, তাই হাসলাম না।
ওঃ।
রাবেয়া চায়ের পেয়ালা হাতে বেরিয়ে গেল। সে খুব অপ্রস্তুত হয়েছে। চোখ লজ্জায় ভিজে উঠেছে। আমার খারাপ লাগতে লাগল। অন্য সময় হলে ঐ গল্পেই প্রচুর হাসতাম। আজ পারিনি। হয়তো মায়ের কথা ভাবছিলাম বলে। চায়ের পেয়ালা হাতে বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই দেখি মন্টু গুটিগুটি পায়ে বেরিয়ে এসেছে।
কিরে মন্টু?
ঘুম আসছে না। দাদা।
কেন?
রুনু ঝুনু ঘুমিয়ে পড়েছে, আমার একা একা ভয় লাগছে।
কিসের ভয়?
ভূতের।
রাবেয়া রান্নাঘরে ফিরে যাচ্ছিল, মন্টু ডাকল, আপা, আমি চা খাব।
এক ফোঁটা ছেলের রাত তিনটের সময় চা চাই। সিগারেটও লাগবে নাকি বাবুর? দিই বাবার কাছ থেকে এনে?
আপা, ভালো হবে না বলছি।
ও ঘর থেকে কাপ নিয়ে আয় একটা। দেখিস, ফেলে দিয়ে একাকার করিস না।
ভোর হয়ে আসছে, কাক ডাকছে। মুরগির ঘরে মুরগিগুলি সাড়াশব্দ দিচ্ছে, চাঁদের আলোও ফিকে হয়ে এসেছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভোর হওয়া দেখছি। ভেতরের ঘর থেকে বাবা বেরিয়ে এলেন, ভীত গলায় ডাকলেন, খোকা।
জ্বি,
তোর মাকে মনে হয়। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়াই ভালো।
কেন? হঠাৎ করে?
না, মানে সুহাসিনী বলল। এখন বয়স হয়েছে কিনা। তা ছাড়া–
তা ছাড়া কী?
না, মানে কিছু নয়। আমার কেন যেন খারাপ লাগছে স্বপ্নটা দেখার স দেখলাম যেন আমি একটা ঘরে…।
একটা ঘরে কী?
না না, রাতের বেলায় স্বপ্ন বলে নাকি কেউ।
বাবা থতমত খেয়ে চুপ করলেন। মায়ের সেই ভয়-ধরান চিৎকার আর শোনা যাচ্ছে না। কোথা থেকে দুটি বেড়াল এসে ঝগড়া করছে। অবিকল শিশুদের কান্নার আওয়াজ। বাবা বললেন, খোকা আমি হাসপাতালে গিয়ে অ্যাম্বুলেন্সকে খবর দিই।
আপনার যেতে হবে না, আমি যাই। বরঞ্চ পাশের বাড়ি থেকে ফোন করে দিই।
না-না, ফোন করলে কাজ হবে না। আসতে দেরি করবে, বাসা চিনবে না।–অনেক ঝামেলা। তুই থাক।