মামা নিনুকে কাছে ডেকে আদর করতে লাগলেন, ফুলের মতো মেয়ে। তুমি যাবে আমার বাসায়? তোমাকে একটা জিনিস দেব।
কী জিনিস? একটা ময়ূর। হিলট্রাক্টে থাকে–এক বন্ধু—আমাকে দিয়েছিল।
পেখম হয়?
হয় বোধকরি। আমি অবশ্যি পেখম হতে দেখি নি।
আমি বললাম, মামা, মার একটা পুরনো রেকর্ড ছিল নাকি?
হ্যাঁ হ্যাঁ, আছে এখনো। তুমি চাও সেটি?
শুনতে ইচ্ছে হয় খুব।
নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। মারা গান শুনতে ইচ্ছে তো হবেই। পাঠিয়ে দেব আমি, আমার মনে থাকবে।
ঝুনুকে শেষ পর্যন্ত আসতে দিল তারা।
তিন বৎসর পর দেখছি। মা হতে যাবার আগের শারীরিক অস্বাভাবিকতায় একটু যেন লজ্জিত। ছেলেবেলার উচ্ছ্বলতা ঢাকা পড়েছে অপরূপ কমনীয়তায়। মোটা হওয়াতে একটু যেন ফর্সা দেখাচ্ছে।
দুপুরবেলা সে যখন এসেছে, তখন আমি কলেজে। মন্টু পাশের বাড়ি থেকে ফোন করল আসতে। পরীক্ষণ-সংক্রান্ত জরুরী মীটিং ছিল, আসতে পারলাম না। সারাক্ষণই ভাবছিলাম, কেমন না জানি হয়েছে বুঝুনুটা। সেদিনও একটা চিঠি পেয়েছি, তুমি তো মনে কর বিয়ে করে ঝুনু বদলে গেছে। বাসার কারো সঙ্গে কোনো যোগ নেই। তাই বাসার কোনো খবরই আমাকে দাও না। রাবেযা আপার যে জ্বর হয়েছিল, সে তো তুমি কিছু লেখি নি। বাবার চিঠিতে জানলাম। আর আমি এত কেঁদেছি, তোমরা সবাই আমাকে পায় মনে করছ, এই জন্যে। মন্টুর কবিতার বই বেরিয়েছে, মন্টু আমায় পাঠায় নি। আমি নিজে যখন একটা কিনেছি, তার দশ দিন পর সে বই পাঠিয়েছে। কেন, আগে পাঠালে কী এমন ক্ষতি হত? মন্টু তার বইয়ে পেন্সিল দিয়ে লিখেছে, সুক্রন্দসী বন্ধু ঝুনুকে। আমি বুঝি সুক্রন্দসী? মন্টুকে হাতের কাছে পেলে কাঁদিয়ে ছাড়ব… ।
সন্ধ্যাবেলা বাসায় এসে শুনি ঋনুপাশের বাড়ি বেড়াতে গেছে। চায়ের পেয়ালা হাতে বারান্দায় একা একা বসে পেপার দেখছি, এমন সময় সে এল। কি একটা ব্যাপারে ভীষণ খুশি হয়ে হাসতে হাসতে আসছে। আমায় লক্ষ করে নি দেখে নিজেই ডাকলাম, ঝনু, আয় এদিকে।
ঝনু প্রথমে থতমত খেল। তারপর কিছু বোঝবার আগেই তার হাতের ধাক্কায় আমার হাত থেকে চায়ের পেয়ালা ছিটকে পড়ল। এবং প্রথমেই যা বুঝতে পারলাম, তা হচ্ছে ঝুনুটা আমায় জড়িয়ে ধরে ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে। প্রথম উচ্ছ্বাসটা কাটল অল্পক্ষণেই, কান্না থামল না। অনেক দিন পর প্রিয় জায়গায় ফিরে আসা, রুনুর মৃত্যু, নিজের জীবনের অশান্তি–সব মিলিয়ে যে কান্না, তা একটু দীর্ঘস্থায়ী তো হবেই। আমি বললাম, ঝুনু, চা খা, তারপর আবার কান্না শুরু কর। মন্টু তোকে সুক্রন্দসী কি আর শুধু শুধু লিখেছে?
কাঁদুক, ঝুনু কাঁদুক। অনেক দিন এ বাড়িতে কেউ কাঁদে না। সেই কবে রুনু মারা গেল। খুব কাঁদল সবাই। বাবা গলা ছেড়ে কাঁদলেন, মন্টু আর রাবেয়া ছেলেমানুষের মতো কাঁদল। নিনু চুপি চুপি আমার গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ল। তারপর আর এ বাড়িতে কান্না কই? নিনু পর্যন্ত ভুলেও কাঁদে না! রাবেয়া হয়তো কাঁদে, আমার তো কখনো চোখে পড়ে না : কাঁদুক ঝুনু। আমি দেখি তাকিয়ে তাকিয়ে সুক্রন্দসী ঝুনুকে।
ঝনুর সঙ্গে সঙ্গে মনে হল পুরনো দিনগুলি যেন ফিরে এসেছে। আগের মতো হৈ-হল্লা হতে লাগল। নিনুর চুল ঘন হয়ে উঠবে বলে এক দিন ঝুনু মহা-উৎসাহে নিনুর মাথা মুড়িয়ে দিল। নিনু তার কাটা চুল লুকিয়ে রাখল তার পুতুলের বাক্সে। এই নিয়ে ফুর্তি হল খুব। মন্টু ছড়া লিখল একটা–নিনুর চুল। নিজের পত্রিকায় ছবি দিয়ে ছাপিয়ে ফেলল। সেটি। নিনুও মন্টুর খাতায় গোপনে লিখে রাখল মন্টু ভাই একটা বোকা রোজ খায় তেলাপোকা। ঝুনু সবাইকে এক দিন সিনেমা দেখাল। রোববারে পিকনিক হল আমগাছের তলায়। সময় কাটতে লাগল বড় সুখে।
সেদিন সন্ধ্যাবেলা মাথার যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে শুয়ে আছি। ঝুনু এসে বলল, মাখায় হাত বুলিয়ে দেব দাদা?
না, এমনি সারবে।
আহা, দিই না একটু।
ঝুনু বসল। মাথার কাছে। মনে হল কিছু বলবে। চুপ করে অপেক্ষা করছি। ঝুনু ইতস্তত করে বলল, আচ্ছা দাদা, হাসপাতালে নাকি ছেলে বদল হয়ে যায়?
ছেলে বদল! কী রকম?
অবাক হয়ে তাকাই আমি।
ওভারশীয়ার চাচার ছেলের বউ বলছিল, হাসপাতালে নাকি ছেলেমেয়েদের নম্বর দিয়ে সব এক জায়গায় রাখে। নম্বরের গণ্ডগোল হলেই এক জনের ছেলে আরেক জনের কাছে যায়।
হেসে ফেললাম। আমি। বললাম, এই দুশ্চিন্তাতেই মরছিস? পাগল আর কি!
না দাদা, সত্যি। ওর এক বন্ধুর নাকি টুকটুকে ফর্সা এক ছেলে হয়েছিল।
রিলিজের সময় যে-ছেলে এনে দিল, সেটি নিগ্রোর চেয়েও কালো।
হাসপাতালে যেতে না চাস, বাসায় ব্যবস্থা করা যাবে। তবে এগুলো খুব বাজে কথা ঝনু।
দুজনেই চুপচাপ থাকি। বুঝতে পারছি, ঝুনুর ছেলের কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে। নিজেই জিজ্ঞেস করি, ছেলে হলে কী নাম রাখবি, ঝুনু?
যাও।
বল শুনি, একটা তো ভেবেছিস মনে মনে।
আমি যেটা ভেবেছি, সেটা খুব বাজে–পুরনো।
কী সেটি?
উঁহু।
বল না, শুনি কেমন নাম।
কিংশুক।
এই বুঝি তোর পুরনো নাম?
যাও দাদা, শুধু ঠাট্টা।
মেয়ে হলে কী রাখবি?
মেয়ে হলে রাখব রাখী।
চমৎকার!
রাখী নামে আমার এক বন্ধু ছিল। এত ভালো মেয়ে! এখন ডাক্তার। আমিও আমার মেয়েকে ডাক্তগরি পড়াব দাদা।
আমার অসুখবিসুখ হলে আর চিন্তাই নেই। ভাগ্নীকে খবর দিলেই হল।
আচ্ছা দাদা, ইরিত্রা নামটা তোমার কেমন লাগে?
নতুন ধরনের নাম। আধুনিক।