ব্যথাটা বোধহয় কমেছে। সহজভাবে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। মার মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম আর ফ্যাকাশে ঠোঁট ছাড়া অসুস্থতার আর কোনো লক্ষণ নেই।
খোকা, মন্টু এসেছে?
এসেছে।
আর রুনুর ঘর খুলে দিয়েছে রাবেয়া?
দিয়েছে।
যা, ওদের নিয়ে আয়।
রুণু ঝুনু আর মন্টু জড়সড় হয়ে দাঁড়াল সামনে। কিছুক্ষণ চুপ থেকেই মা বললেন, কাঁদছ কেন রুনু?
কাঁদছি না তো।
বেশ, চোখ মুছে ফেল। ভাত খেয়েছ?
না।
যাও, ভাত খেয়ে ঘুমাও গিয়ে।
মন্টু বলল, মা, আমি বাবার জন্যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকব?
না-না। ঘুমাও গিয়ে। রুনু মা, কাঁদছ কোন তুমি?
কাঁদছি না তো।
আমার কিছু হয় নি, সবাই যাও, ঘুমিয়ে পড়। যাও, যাও।
ঘর থেকে বেরিয়েই কেমন যেন খারাপ লাগতে লাগল আমার। আমাদের এই গরিব ঘর, বাবার অল্প মাইনের চাকরি। এর ভেতরে মা যেন সম্পূৰ্ণ বেমানান।
বাবার সঙ্গে তাঁর যখন বিয়ে হয়। তিনি ৩ খন ইতিহাসে এম. এ. পরীক্ষা দেবেন। আর বাবা তাঁদের বাড়িরই আশ্রিত। গ্রামের কলেজ থেকে বি. এ. পাশ করে চাকরি খুঁজতে এসেছেন শহরে। তাঁদের কী-যেন আত্মীয় হন।
বিয়ের পর এই বাড়িতে এসে ওঠেন দু জন। মার পরীক্ষা দেওয়া হয় নি। কিছু দিন কোনো এক স্কুলে মাস্টারি করেছেন। সেটি ছেড়ে দিয়ে ব্যাঙ্কে কী-একটা চাকরিও নেন। সে চাকরি ছেড়ে দেন। আমার জন্মের পরপর। তারপর একে একে রুণু হল, ঝুনু হল, মন্টু হল–মা গুটিয়ে গেলেন নিজের মধ্যে।
সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে মা আমাদের গরিব ঘরে এসেছেন বলেই তাঁর সামান্য রূপের কিছু কিছু আমরা পেয়েছি। তাঁর আশৈশব লালিত রুচির কিছুটা (ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ হলেও) সঞ্চারিত হয়েছে আমাদের মধ্যে। শুধু যার জন্যে ভূষিত হয়ে আছি, সেই ভালোবাসা পাই নি কেউ। রাবেয়ার প্রতি একটি গাঢ় মমতা ছাড়া আমাদের কারো প্রতি তার কোনো আকর্ষণ নেই। মারি অনাদর খুব অল্প বয়সে টের পাওয়া যায়, যেমন আমি পেয়েছিলাম। রুনু ঝনুও নিশ্চয়ই পেয়েছে। অথচ আমরা সবাই মিলে মাকে কী ভালোই না বাসি।
উকিল সাহেবের বাসায় টেলিফোন আছে। সেখান থেকে ছোট খালার বাসায় টেলিফোন করলাম। ছোট খালা বাসায় ছিলেন না, ফোন ধরল কিটকি।
কী হয়েছে বললেন খোকা ভাই?
মার শরীর ভালো নেই।
কী হয়েছে খালার?
কী হয়েছে বলতে গিয়ে লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছিল, এদিকে উকিল সাহেব আবার কান খাড়া করে শুনছেন কী বলছি। কোনো রকমে বললাম, মার ছেলে হবে কিটকি।
আপনাদের তো ভারি মজা, কতগুলি ভাই-বোন। আমি একদম একা।
কিটকি, খালাকে সকাল হলেই বাসায় এক বার আসতে বলবে।
হ্যাঁ বলব। আমিও আসব–।
মার বাড়ির লোকজনের ভেতর এই একটিমাত্র পরিবারের সঙ্গে আমাদের কিছুটা যোগাযোগ আছে। ছোট খালা আসেন মাঝে মাঝে। কিটকির জন্মদিন, পুতুলের বিয়ে–এই জাতীয় উৎসবগুলিতে দাওয়াত হয়। রুনু-ঝুনুর।
বাসায় ফিরে দেখি বাবা এসে গেছেন। ওভারশীয়ার কাকুর বউ এসেছেন, ধাই সুহাসিনীও এসেছে। রান্নাঘরে বাতি জ্বলছে। রাবেয়া ব্যস্ত হয়ে এঘর-ওঘর করছে। বাবা ভেতরের বারান্দায় ইজিচেয়ারে শুয়ে ঘন ঘন সিগারেট খাচ্ছেন। আমাকে দেখে যেন একটু জোর পেলেন। তোর ছোটখালাকে খবর দিয়েছিস খোকা?
জ্বি দিয়েছি। আপনি কখন এসেছেন? আমার একটু দেরি হয়ে গেল। তোর আজিজ খাঁকে মনে আছে? ঘড়ির দোকান ছিল যে, আমার খুব বন্ধুমানুষ। সে হঠাৎ মারা গেছে। গিয়েছিলাম তার বাসায়।
বাবা যেন আমার কাছে কৈফিয়ৎ দিচ্ছেন, এমন ভাব-ভঙ্গি করতে লাগলেন, আজিজ খাঁর বউ ঘন ঘন ফিট হচ্ছে। এক বার মনে করলাম থেকেই যাই। ভাগ্য ভালো থাকি নি, নিজের ঘরে এত বড়ো বিপদ।
বিপদ কিসের বাবা?
না। বিপদ অবশ্যি নয়। কিন্তু রাতে এমন একটা বাজে স্বপ্ন দেখেছি। যতবারই মনে হয়, হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে। কিছুক্ষণ আগে রাবেয়াকে বলেছি সে-কথা।
কী স্বপ্ন?
না-না, রাতের বেলা কেউ স্বপ্ন বলে নাকি রে? যা তুই, রাবেয়ার কাছে গিয়ে বস একটু।
ঘরে যদিও অনেকগুলি প্ৰাণী জেগে আছি। তবু চারদিক খুব বেশিরকম নীরব। রান্নাঘরে দু-একটি বাসনকেশন নাড়ার শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না। বাবা অবশ্যি মাঝে মাঝে বিড়বিড় করে কী যেন বলছেন। তাঁর একা একা কথা বলার অভ্যাস আছে। মাঝে মাঝে যখন মেজাজ খুব ভালো থাকে, তখন গুনগুন করে গানও গান। কথা বোঝা যায় না, ও মন মন রে এই লাইনটি অস্পষ্ট শোনা যায়। রাবেয়া বলে, বাবার নৈশ সংগীত। রাবেয়াটা এমন ফাজিল।
রান্নাঘরে গিয়ে দেখি একটা মস্ত এলুমোনিয়ামের সসপ্যানে পানি ফুটছে। রাবেয়ার ঘুম ঘুম ফোলা মুখে আগুনের লাল আঁচ এসে পড়েছে। সে আমার দিকে তাকিয়ে কি ভেবে অল্প হাসল। আমি বললাম, হাসছিস যে?
এমনি। সুহাসিনী মাসির আমি কী নাম দিয়েছি জানিস?
কী নাম?
কুহাসিনী মাসি। ওর হাসি শুনলেই আমার গা জ্বলে। একটু আগে কী বলেছে। छोनिन?
কী বলেছে?
থাক, শুনে কাজ নেই।
বল না?
বলে, আজ তোমার মার জনো এসেছি, এক দিন তোমার জন্যেও আসব খুকি। বলতে বলতে রাবেয়া মুখ নিচু করে হাসল। সে মনে হল কথাটা বলে ফেলে বেশ লজ্জা পেয়েছে। হঠাৎ করে ব্যস্ত হয়ে কী খুজতে লাগল মিটসোফে। আমি বললাম, ৩োর ভাবভঙ্গি দেখে তো মনে হচ্ছে বেশ খুশিই হয়েছিস শুনে।
তুই একটা গাধা।
লজ্জায় ব্রাবেয়া লাল হয়ে উঠল। আমি অপ্রস্তুত হয়ে বললাম লজ্জা পাওয়ার কী হয়েছে?
যা! লজ্জা পেলাম কোথায়, তোর যে কথা! যাই, দেখে আসি রুনু-ঝনুরা মশারি ফেলে ঘুমিয়েছে কি না, যা মশা!