কি রে রুনু, টাকা দরকার?
ন্-না।
সেদিন যে দশ টাকা দিলাম, খরচ করে ফেলেছিস?
হুঁ,
আরো চাই?
ন্-না।
আচ্ছা আচ্ছা, প্যান্টের পকেটে হাত দে, মানি ব্যাগ পেয়েছিস? খোল। নে একটা নোট, নিয়ে যা! আরে আরে, দশ টাকারটাই নিলি? ডাকাত একেবারে! রুনু খিলখিল হেসে পালিয়ে যায় দ্রুত।
সেই রুনু এমন বদলে গেল। আমরা কেউ বুঝতেই পারলাম না। পরীক্ষার রেজাল্ট শুনে তার কোনোই ভাবান্তর নেই। সেদিন শুনি জানালা দিয়ে মুখ বের করে ওভারশীয়ার চাচাকে বলছে, ও চাচাজি, শুনছেন?
কি মা?
কি রেজাল্ট?
আমি ফেল করেছি। চাচাজি।
একমাত্র বাবাই রুনুকে ধরতে পেরেছিলেন। প্রায়ই বলতেন, রুলুটার কি কোনো অসুখ করেছে? এমন দেখায় কেন? এক দিন রুনিকে আসমানী রঙের একটি চমৎকার শাড়ি এনে দিলেন। সিনেমা দেখাতে নিয়ে গেলেন। শেষ পর্যন্ত মন ভালো থাকবে বলে পাঠালেন। ঝুনুর কাছে।
ঝুনুর বাসা থেকে ফিরে এসেই রুনু অসুখে পড়ল। প্রথমে একটু জ্বর-জ্বর ভাব, সর্দি, গা ম্যাজম্যাজ। শেষটায় একেবারে শয্যাশায়ী।
এক দিন দু দিন করে দিন পনের হয়ে গেল, অসুখ আর সারে না। ডাক্তার কখনো বলে দুর্বলতা, কখনো বলে রক্তহীনতা, কখনো-বা লিভার টাবল। সঠিক রোগটা আর ধরা পড়ে না।
রাতে সে বড়ো ঝামেলা করে। নিজে একটুও ঘুমোয় না, কাউকে ঘুমুতেও দেয় না। রাবেয়া প্রায় সারা রাত জেগে থাকে। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, গল্প পড়ে শোনায়, পিঠ চুলকে দেয়। অনেক রাতে যখন রাবেয়া বলে, আমি একটু শুই, রুনু?
না-না, শুলেই তুমি ঘুমিয়ে পড়বে।
তোর বালিশে একটু মাথাটা রাখি, ভীষণ মাথা ধরেছে।
উঁহু, তুমি বরং এক কাপ চা খেয়ে আসা। ঘুমুতে পারবে না।
খোকাকে ডাকি, ও বসবে তোর পাশে।
না, তুমি বসে থাকবে।
কলেজ থেকে ফিরে আমি এসে বসি রুনুর পাশে।
কি রে, জ্বর কমেছে।
হা, কমেছে?
কপালে হাত দিয়েই প্রবল জ্বরের আচা পাই। রুনু ঘোলাটে চোখে তাকায়। আমি বলি, বেশ জ্বর তো! কি রে, খারাপ লাগে?
না, লাগে না।
মাথায় হাত বুলিয়ে দেব?
দাও।
চিটাগাং ভালো লেগেছিল রুনু?
হুঁ।
সমুদ্র দেখতে গিয়েছিলি?
না।
আচ্ছা, এক বার তোদের সবাইকে নিয়ে সমুদ্র দেখতে যাব। কক্সবাজারে হোটেল ভাড়া করে থাকব। খুব ফুর্তি করব, কি বলিস?
হুঁ করব।
জ্বরের ঘোরে রুনু ছটফট করতে লাগল। হঠাৎ অপ্রাসঙ্গিক ভাবে বলে উঠল, দাদা, ঝুনু এখন আর আমাকে একুটুও দেখতে পারে না।
কেন দেখতে পারে না?
কী জানি কেন। আমার সঙ্গে কথা বলে নি। কিন্তু আমার কী দোষ?
রুনুর জ্বর বাড়তেই থাকে। মন্টু চলে যায় ডাক্তার আনতে। রুনু আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে থাকে। ভাত খেতে খেতে রাবেয়া বলে, খোকা শোন, তোকে একটা কথা বলি?
কী কথা?
রুনুটা বাঁচবে না রে!
কী বলছিস আরোল-তাবোল!
আমার কেন জানি শুধু মনে হচ্ছে। কাল রাতে রুনুর জন্যে গরম পানি করে নিয়ে গেছি, দেখি ওর মাথার পাশে কে এক জন মেয়ে বসে আছে।
কী বলছিস এ সব!
হ্যাঁ সত্যি। কে যে বসে ছিল, ঠিক বলতে পারব না। তবে আমার মনে হয়, তিনি মা। অল্প কিছুক্ষণের জন্যে দেখেছি।
যত সব রাবিশ।
না রে, ঠিকই। আমি ভয় পেয়ে বাবাকে ডেকে আনি।
বাবাকে বলেছিস কিছু?
না, বলি নি।
দেখতে দেখতে রুনুর জ্বর খুব বাড়ল। ছটফট করতে লাগল সে। ডাক্তার এসে দুটি ইনজেকশন করলেন। মাথায় পানি ঢালতে বললেন। জ্বরের ঘোরে রুনু ভুল বকতে লাগল, বেশ করেছেন আপনি! হ্যাঁ, বেশ তো। ঠিক আছে ঠিক আছে!
কী বলছিস রুনু?
রুনু স্বাভাবিক মানুষের মতো বলল, কই দাদা, কিছু বলছি না তো। রাবেয়াকে বলল, আপা এক গ্লাস পানি আন। কানায় কানায় ভরা থাকে যেন। আমি সবটা চুমুক দিয়ে খাব।
রুনু এক চুমুক পানি খেল। খুব স্বাভাবিক গলায় ডাকল, বাবা।
এই তো আমি। কী মা?
একটু কোলে নেন না।
বাবা রুনুকে কোলে নিলেন। বাবার পা কাঁপছিল। আমি বাবার একটা হাত ধরলাম। রুনুটা এই কদিনে ভীষণ রোগা হয়েছে। বাবার পিঠের ওপর তার দুটি শীর্ণ হাত আড়াআড়ি ঝুলছে। রুনু বলল, বাবা বাইরে চলেন। বাইরে যাব।
সবাই বাইরে এসে দাঁড়ালাম। সে রাতে–খুব জোছনা হয়েছিল। জামগাছের পাতা চিকচিক করছিল জোছনায়। উঠোনে চমৎকার সব নকশা হয়েছিল গাছের পাতার ছায়ায়। রুনু ফিসফিস করে বলল, বাবা, কাল রাতে আমি মাকে দেখেছি। মা আমার মাথার পাশে এসে বসেছিলেন। আমি কি মারা যাচ্ছি। বাবা?
না মা, ছিঃ! মারা যাবে কেন?
তোমরা কি রাগ করেছ আমার ওপর?
রাগ করব কেন? মিষ্টি মা আমার।
বাবা চুমু খেলেন রুনুর পিঠে। রুনু বলল, আমি য়ে আরেকটি ছেলেকে চিঠি লিখেছিলাম।
রাবেয়া রুনুকে কোলে নিয়ে বসে আছে। বাবা আর মন্টু গেছে ডাক্তার ডেকে আনতে। রুনু চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। তার ফর্সা সরু আঙুল থরথর করে কাঁপছে। সবাই বুঝতে পারছি, রুনু মারা যাচ্ছে… ।
রুনু মারা যাবার পর
রুনু মারা যাবার পর আমার মনে হল মায়ের মৃত্যু আমি ঠিক অনুভব করতে পারি নি। মা যখন মারা যান। তখন অনেক রকম দুশ্চিন্তা ছিল, নিনুকে কে মানুষ করবে, ঘর-সংসার কী করে চলবে। কিন্তু এখন কোনো দুশ্চিন্তা নেই। রুনুর জন্যে কোনো কিছু আটকে থাকার কথা ওঠে না, কিন্তু সমস্তই যেন আটকে গেল। রুনুর কথা মুহূর্তের জন্যেও ভুলতে পারি না। মনে হয় গভীর শূন্যতায় ক্রমাগত তলিয়ে যাচ্ছি। অসহ্য বোধ হওয়ায় লম্বা ছুটি নিয়েছি। দীর্ঘ অবসর সময়ও কাটে না কিছুতেই। একবার ভাবলাম বাইরে কোথাও যাই। কত দিন রুনুকে নিয়ে বাইরে যেতে চেয়েছি, সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড়, কক্সবাজার, দিনাজপুরের পঞ্চগড়–কিন্তু যাওয়া হয়ে ওঠে নি। আজ একা এক কি করে যাব?