না, কিছু হয় নি। ভাবলাম তোর সঙ্গে একটু গল্প করি।
রুনু অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল আমার দিকে। হঠাৎ করেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলতে লাগল, তোমার গা ছুঁয়ে বলছি দাদা, আমার একটুও খারাপ লাগছে না। আমি বেশ আছি।
সবুজকে বিয়ে করবি রুনু?
ন্-না। ছিঃ!
না কেন?
না-কক্ষনো না, ওটা একটা বদমাশ!
তবে যে চিঠি লিখেছিলি?
এমনি, তামাসা করতে, ও যে লিখত খালি খালি।
আয় রুনু, বাইরে হাঁটি একটু দেখ কি জোছনা
রুনু জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। সত্যি অপরূপ জোছনায় সব যেন ভেসে যাচ্ছে। চারদিক চিকচিক করছে নরম আলোয়। আপনাতেই মনের ভেতর একটা বিষন্নতা জমা হয়। আমি বললাম, এটা কী মাস বল তো রুনু।
অক্টোবর মাস।
বাংলা বল।
বাংলাটা জানি না। ফাল্গুন?
না, আশ্বিন। আশ্বিন মাসে সবচেয়ে সুন্দর জোছনা হয়। আয়, বাইরে গিয়ে দেখি।
ঘরের বাইরে এসে দাঁড়াতেই মন জুড়িয়ে গেল। ঝিরঝির করে বাতাস বইছে। ফুটফুটে জোছনা চারদিকে। সব কেমন যেন স্বপ্নের মতো মনে হয়। বড়ো ভালো লাগে।
ওটা কে দাদা? ঐ যে চেয়ারে বসে?
তাকিয়ে দেখি কে যেন ইজিচেয়ারে মূর্তির মতো বসে আছে। একটা হাত অবসান্নভাবে ঝুলছে। অন্য হাতটি বুকের উপর রাখা। বসে থাকার সমস্ত ভঙ্গিটাই কেমন দীন-হীন, কেমন দুঃখী। আমি বললাম, ও হচ্ছে রাবেয়া। চিনতে পারছিস না?
না তো। চল, আপার কাছেন যাই।
না, ও থাকুক একা একা। আয়, এদিকে আয়।
রুনু হাঁটতে হাঁটতে আমার একটা হাত ধরল। ছোটবেলায় যেমন করত, তেমনিভাবে হাতের আঙুল নিয়ে খেলা করতে করতে হালকা গলায় বলল, দাদা, তোমরা কি আমার ওপর বিরক্ত হয়েছ?
কেন?
চিঠি লিখেছি বলে?
তোর কী মনে হয়?
রুনু কথা বলল না। চুপচাপ হাঁটতে থাকল! আমি খুললাম, রুনু, ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে?
কোন কথা?
তুই যে এক দিন পালিয়েছিলি?
ও মনে আছে। ঝানু একটা কাপ ভেঙে ফেলেছে। ভেঙেই দৌড়ে পালাল, আর আম্মা এসে আমার গালে ঠাস করে এক চড়!
রুনু বলতে বলতে হাসতে লাগল। আমি বললাম, তারপর কি ঝামেলায় পড়লাম সবাই। তোর কোনো খোঁজ নেই। সকাল গেল, দুপুর গেল, সন্ধ্যা গিয়ে রাত, তবু তের খবর নেই। বাসায় খাওয়াদাওয়া বন্ধ। বাবা সারা দিন খুঁজেছেন। এখানে ওখানে। আড়ালে আড়ালে চোখের পানি ফেলেছেন। আমি থানায় খবর দিতে গেছি। মা কিন্তু বেশ স্বাভাবিক, যেন কিছুই হয় নি। আর ঝুনুটা করল কি, সন্ধ্যাবেলায় রাবেয়াকে জড়িয়ে ধরে ভেউ ভেউ করে সে কী কান্না। কোনোমতে বলল, আপা আমিই ভেঙেছি কাপটা, রুনু ভাঙে নি!
তোর সব মনে আছে রুনু?
খুব মনে আছে। আমি চুপচাপ বসে আছি ছাদে। তোমরা তো কেউ ছাদে খুঁজতে আস নি। সারা দিন একা এক বসেছিলাম। রাত হতেই ভূতের ভয়ে নেমে এসেছি।
তারপর কী হল বল তো রুনু?
আরেকটা চড় খেলাম।
চড়টা কে দিয়েছিল মনে আছে?
হ্যাঁ, তুমি।
সশব্দে দু জনে হেসে উঠলাম।
কে? কে হাসছে?
তাকিয়ে দেখি রাবেয়া টলতে টলতে আসছে।
ও তোরা। বেশ ভয় পেয়েছি। হঠাৎ করে হাসলি। ধক করে উঠছে বুকটা।
বস রাবেয়া, গল্প করি।
না, ভোর হয়ে আসছে দেখছিস না। সবাই চা-টা খাবে। এত মানুষের ব্যাপার, আমি রান্নাঘরে যাই।
চল আপা, আমিও যাই।
আমি একা একা বসে রইলাম।
ভোরের কাকের কা-কা শোনা যাচ্ছে। আকাশ ফর্সা হয়ে উঠেছে ধীরে ধীরে।
বুঝতে পারছি মনের ভেতর জমে থাকা অবসাদ কেটে যাচ্ছে। ঠিক ভোর হবার মুহূর্তে মনের গ্লানি কেটে যায়। সুন্দর সুখের স্মৃতিগুলি ফিরে আসে। কিটকি লিখেছে, ‘গতকাল নৌকায় করে ৬ মেইল উত্তরের ক্যানসি সিটিতে গিয়েছিলাম বেড়াতে। ওমা! আমাদের দেশের ময়লা ঘিঞ্জি চাঁদপুরের মতো দেখতে। এটিকে আবার বাহার করে বলা হচ্ছে সিটি। শহরটা বাজে, বমি আসে। কিন্তু শহর থেকে বেরুলেই চোখ ভরে ওঠে। নীল সমুদ্র, নীল নীল পাহাড়, ঘন নীল আকাশ। উহ্, কী অদ্ভুত! আপনি যদি আসতেন, তাহলে খুব ভালো লাগত আপনার। সত্যি বলছি।
আই. এ পরীক্ষায় রুনু ফেল করল।
বেশ অবাক হলাম। আমরা। পড়াশোনায় আমার সব ভাইবোনই ভালো। রুনু নিজে সাত শর উপর নম্বর পেয়ে ম্যাটিক পাশ করেছিল। অঙ্কে আর ভূগোলে লেটার মার্ক ছিল। পরীক্ষায় একেবারে ফেল করে বসবে, এটা কখনো ভাবা যায় না। কাগজে তার রোল নাম্বার যখন কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছি না এবং রোল নম্বরটি পাওয়া যাবে না এটিও ধারণা করতে পারছি না, তখন রুনু বলল, খুঁজে লাভ হবে না দাদা, আমি ফেল করেছি।
ফেল করবি কেন?
খাতায় যে কিছুই লিখি নি। ইতিহাসের খাতায় সম্রাট বাবরের ছবি এঁকে দিয়ে এসেছি।
কার ছবি?
সম্রাট বাবরের।
আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। রুনু অবশ্যি বদলে যাচ্ছিল। কিন্তু পরিবর্তনটা এত ধীর গতিতে হচ্ছিল যে আমি ঠিক ধরতে পারিনি। হয়তো বই নিয়ে পড়তে বসেছে, আমি যাচ্ছি পাশ দিয়ে–হঠাৎ ডাকল, দাদা, শোন একটু।
কি?
মানুষের গোস্ত যদি বাজারে বিক্রি হত তাহলে তোমার গোস্ত হত সবচে সস্তা, তুমি যা রোগ।
এই জাতীয় কথাবার্তা রুনু আগে বলত না। কিংবা আরেকটি উদাহরণ ধরা যাক।
এক দিন রাবেয়াকে গিয়ে সে বলছে, আপা, একটা কথা শুনবে?
বল।
তোমার মাথাটা কামিয়ে ফেলবো?
রাবেয়া বিস্মিত হয়ে বলল, কেন রে?
এমনি বলছি। ঠাট্টা করছি।
রুনুর এ জাতীয় কথাবার্তা কোনো বিক্ষিপ্ত ঘটনা নয়। রুনু বদলে যাচ্ছিল। কথাবার্তা কমিয়ে দিচ্ছিল। অথচ তার মতো হৈচৈ করা মেয়ে আমি খুব কম দেখেছি। বাসায় যতক্ষণ আছে, গুনগুন করে গান গাইছে। রেডিও ক্যানের কাছে নিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে বিছানায়! সিনেমার তো কথাই নেই, প্রতি সপ্তায় দেখা চাই। তার হাতে টাকা পড়তে না পড়তে ধোঁয়ার মতো উড়ে যাচ্ছে। যখনই দেখতাম রাতের খাওয়ার পর রুনু আমার ঘরে ঘুরঘুর করছে কিংবা আমার টাকায় প্রয়োজন।