না।
চল না, যাই সবাই মিলে। কত দিন ছবি দেখি না।
তুই যা রুনু-ঝনুদের নিয়ে–কত কাজ ঘরের।
যা কাজ, রুনু-ঝুনুই করতে পারবে। আয়, তুই আর আমি দু জনে যাই।
না রে, ইচ্ছে করছে না।
তাহলে চল, একটু বেড়িয়ে আসি।
কোথায়?
তুই যেখানে বলিস।
আজ থাক।
আমি অস্বস্তিতে ছট্ফটু করি। রাবেয়ার দিকে চোখ তুলে তাকাতেও লজ্জা হয়। যেন তার মানসিক দুঃখ-কষ্টের অনেকটা দায়ভাগ আমার।
এক দিন রাবেয়া নিজেই বলল, চল খোকা, বেড়িয়ে আসি?
আমি খুশি হয়ে বললাম, চল, সারা দিন আজ ঘুরব। বল কোথায় কোথায় যাবি?
প্রথম যাব আমার এক বন্ধুর বাসায়। একটা রিক্সা নে!
রিক্সা যে-বাড়ির সামনে থামল, তা দেখে চমকালাম। রাজপ্রসাদ নাকি? বাড়ির সামনে কি প্রকাণ্ড ফুলের বাগান! আমি বললাম, রাবেয়া, তুই ঠিক জায়গায় এসেছিস তো? কার বাড়ি এটা?
আবিদ হোসেনের, ঐ যে ছোটবেলায় আমাকে গাড়িতে করে স্কুলে পৌঁছে দিত।
বাসা কী করে চিনলি?
এসেছিলাম তো তাঁর সঙ্গে বাসায়।
আবিদ হোসেন বাসায় ছিলেন না। এক জন বিদেশিনী মহিলা খুব আন্তরিকভাবে আমাদের বসতে বললেন। কী দরকার, বারবার জিজ্ঞেস করলেন। চমৎকার বাংলা বলেন তিনি।
রাবেয়া বলল, কোনো প্রয়োজন নেই। এমনি বেড়াতে এসেছি। ছোটবেলায় তিনি আমার খুব বন্ধু ছিলেন।
ভদ্রমহিলা কফি করে খাওয়ালেন। বেরিয়ে আসবার সময় মস্ত বড়ো বড়ো কটি গোলাপ তুলে তোড়া করে দিলেন রাবেয়ার হাতে। এক জন অপরিচিত বিদেশিনীর এমন ব্যবহার সত্যিই আশা করা যায় না।
রাবেয়া বেরিয়ে এসে বলল, চল খোকা, এই ফুলগুলি মার কবরে দিয়ে আসি। এই তিনটা দিবি তুই, বাকি তিনটা দেব আমি। আয় যাই।
বেশ কেটে যাচ্ছে দিন। কিটকির চিঠি হঠাৎ মাঝে মাঝে এসে পড়ে। কেমন আছেন ভালো আছি গোছের। একঘেয়ে জীবনের মধ্যে এইটুকুই যেন ব্যতিক্রম। হঠাৎ করে। এক দিন সবার একঘেয়েমী কেটে গেল। মনসুরের বাবা এক সন্ধ্যায় বেড়াতে এসে অনেক ভণিতার পর বাবাকে বললেন, আপনার মেয়ে রুনুকে যদি দেন। আমাদের কাছে, বড়ো খুশি হই। মনসুরের নিজের খুব ইচ্ছা। মনসুরকে আপনি ছোটবেলা থেকেই দেখেছেন। চাকরিও পেয়েছে চিটাগাং স্টীল মিলে, নয় শ টাকার মতো বেতন, কোয়ার্টার আছে। তা ছাড়া আপনার মেয়েরও মনে হয় কোনো অমত নেই।
বাবা সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলেন। বারোই আশ্বিন বিয়ের দিন ঠিক হয়ে গেল। এক মিনিটে বদলে গেল। সারাটা বাড়ি। বাবার সমস্ত অসুস্থতা কোথায় যে পালাল! বিয়ে নিয়ে এর সঙ্গে আলাপ করা, ওর কাছে যাওয়া, বাজারের হাল অবস্থা দেখা, মেয়েকে কী দিয়ে সাজিয়ে দেবেন। সে সম্বন্ধে খোঁজ নেওয়া–এক মুহূর্ত বিশ্রাম রইল না তাঁর।
মন্টু তার বন্ধুদের নিয়ে এসে সারাক্ষণই হৈচৈ করছে। গেট কোথায় হবে, ইলেকটিকের বাম্বে সাজান হবে কি না, কার্ড কয়টি ছাপাতে হবে, নিমন্ত্রণের ভাষাটা কী রকম হবে, এ নিয়ে তার ব্যস্ততা প্রায় সীমাহীন। রাবেয়াকে নিয়ে আমি কেনাকাটা করতে প্ৰায় প্রতিদিনই বেরিয়ে যাই। ঝুনুটা সারাক্ষণ আহাদী করে বেড়ায়। শীতের শুরুতে ঠাণ্ডা আবহাওয়াতে এমনিতেই একটু উৎসবের ছোঁয়াচ থাকে, বিয়ের উৎসবটা যুক্ত হয়েছে তার সাথে।
রুনুর চাঞ্চল্য কমে গেছে। হৈচৈ করার স্বভাব মুছে গেছে একেবারে। সারা দিন শুয়ে শুয়ে গান শোনে। একটু যে কোথাও যাবে, আমাদের সঙ্গে কিংবা বাইরের বারান্দায় এসে বসবে।–তাও নয়। দুপুরটা কাটায় ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে–বড় ভালো লাগে দেখে। যদি বলি, কিরে রুনু, বিয়ের আগেই বদলে গেছিস দেখি।
যাও দাদা, ভালো লাগে না।
তোর চিটাগাং-এর বাড়িতে বেড়াতে গেলে খাতির-যত্ন করবি তো?
না, করব না। তোমাকে বাইরে দাঁড়া করিয়ে রাখব।
রুনুর চোখ জ্বলজ্বল করে। সারা শরীরে আসন্ন উৎসবের কী গভীর ছায়া। মনসুর দেখি প্রায়ই আসে। এক দিন সিনেমার টিকেট নিয়ে এল রুনু-ঝনুর জনে}। রুণু কিছুতে যাবে না। রুনু বলে, নিনুকে নিয়ে যাক। নিনুও যাবে না, আমার জন্যে তো আনে নি। আমি কেন যাব?
এই বয়সেই পাকা পাকা কথা।
এক দিন সে মনসুরের সঙ্গে হেসে হেসে সারা দুপুর গল্প করেছে, আজকে তার সাড়া পেলেই রুনু বন্দী হয়ে যায় নিজের ঘরে। রাবেয়া হেসে হেসে বলে, বেচারা বসে থাকতে থাকতে পায়ে ঝিঝি ধরিয়ে ফেলেছে, রুনু যা, বেচারাকে দর্শন দিয়ে আয়।
থাকুক বসে, আমি যাচ্ছি না।
কোন যাবি না?
রোজ রোজ বেহায়ার মতো আসবে, লজ্জা লাগে না বুঝি?
ঝুনু আর নিনুকে নিয়ে গল্প করে বেচারা সময় কাটায়।
দেখতে দেখতে বিয়ের দিন এসে পড়ল। বাবার দু জন ফুফু এলেন, তাঁর চাচাত ভাইও ছেলে-মেয়ে নিয়ে এলেন। বাড়ি লোকজনে গমগম করতে লাগল। মন্টু কোথেকে একটি রেকর্ড-প্লেয়ার এনেছে। সেখানে তারস্বরে রাত-দিন আধুনিক গান হচ্ছে। ফুফুর ছেলেমেয়ে কটির হল্লায় কান পাত যাচ্ছে না, আশেপাশের বাড়ির ছেলেমেয়েরাও যোগ দিয়েছে তাদের সঙ্গে। পাড়ার ছেলেরা নিজেরাই বাঁশ কেটে ম্যারাপ বাঁধার যোগাড় করছে। বেশ লাগছে। উৎসবের নেশা-ধরান আমেজ। কলেজ থেকে সাত দিনের ছুটি নিয়ে নিলাম।
তিন দিন পর বিয়ে। দম ফেলার ফুরসৎ নেই। দুপুরের ঘুম বিসর্জন দিয়ে কিসের যেন হিসেব কষছি। রাবেয়া পাশেই বসে। রুনু, ঝানু আর ফুফুর দু মেয়ে লুড় খেলছে বসে বসে। বাবা গেছেন নানার বাড়ি। নিনুটা এল এমন সময়। হাসিমুখে বলল, দাদা, তোমাকে ডাকে।
কে?
নতুন দুলাভাই ইঞ্জিনীয়ার সাহেব।