কোনো খবর আছে বোধ হয়?
বলুন না, কী খবর?
দল বেঁধে পিকনিকে যাবি, তাই না?
কিছুটা ঠিক। আমরা ম্যানিলা যাচ্ছি।
কোথায় যাচ্ছিস?
ম্যানিলা। পাঁচ বৎসরের চুক্তিতে আব্বা যাচ্ছেন এই ডিসেম্বরে। কী যে ভালো লাগছে আমার!
খুশিতে ঝলমল করে উঠল কিটকি। বুকে ধক করে একটা ধাক্কা লাগল আমার।
খুব খুশি লাগছে তোর?
হ্যাঁ, খুব।
আমাদের জন্যে খারাপ লাগবে না?
লাগবে না কেন, খুব লাগবে। আমি চিঠি লিখব সবাইকে।
কিটকি, দেখি তোর হাত।
হাত কি দেখবেন?
ইতস্তত করে হাত বাড়িয়ে দেয় কিটকি। লাল টুকটুকে এতটুকু ছোট্ট হাত।
হাত দেখতে জানেন আপনি? এত দিন বলেন নি তো? ভালো করে দেখবেন কিন্তু। সব বলতে হবে।
কিটকির নরম কোমল হাতে হাত রেখে আমি আশ্চর্য যাতনায় ছটফট করতে থাকি।
কী দেখলেন বলুন? বলুন না।
ও এমনি, আমি হাত দেখতে জানি না।
তবে যে দেখলেন?
কি জন্যে দেখলাম, বুঝতে পারিস নি? তুই তো ভরি বোকা।
কিটকি হাসিমুখে বলল, বুঝতে পারছি।
কী বুঝতে পারলি?
বুঝতে পারছি যে, আপনিও বেশ বোকা।
কিটকিরা ডিসেম্বরের ন তারিখে চলে গেল। এ্যারোড্রামে অনেক লোক হয়েছিল। রাবেয়াকে নিয়ে আমিও গিয়েছিলাম সেখানে। কিটকির যে এত বন্ধু আছে, তা জানতাম না। হেসে হেসে সবার সঙ্গেই সে কথা বলল। কিটকিকে মনে হচ্ছিল একটি সবুজ পরী। সবুজ শাড়ি, সবুজ জুতো, সবুজ ফিতে–এমন কি কাঁধের মস্ত ব্যাগটাও সবুজ।
রাবেয়াকে বললাম, কিটকিকে কী সুন্দর মানিয়েছে, দেখেছিস? তুই এমন মিল করে সাঁজ করিস না কেন?
সাজ দেখে যদি তোর মতো কোনো পুরুষ-হৃদয় ভেঙে যায়, সেই ভয়ে।
খালা লাউঞ্জের এক কোণায় বসে ছিলেন। ইশারায় কাছে ডাকলেন।
চললাম রে তোদের ছেড়ে।
ফিরবেন কবে?
কে জানে কবে। কর্তার মার্জি হলেই ফিরব। পাঁচ বছরের মেয়াদ। কিরে রাবেয়া, হাসছিস কী দেখে?
রাবেয়া হাত তুলে দেখাল, এক মেমসাহেব তার বাচ্চা ছেলেটিকে নিয়ে বিষম বিব্রত হয়ে পড়েছেন। বাচ্চাটা দমাদম ঘুষি মারছে মাকে। কিছুতেই শান্ত করান যাচ্ছে না।
সবাই হাসিমুখে দেখছে ব্যাপারটা। খালা বললেন, তুই তো বড়ো ছেলেমানুষ রাবেয়া। বয়স কত হল তোর? আমি যখন সেভেনে পড়ি, তখন তোর জন্ম হল। তার মানে-সে কি। তোর যে ত্ৰিশ পেরিয়েছে! কী ব্যাপার? বুড়ি হয়ে গেলি যে, বিয়ে এখনো হল না? কি মুশকিল!
রাবেয়া স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে রইল। আমি চোখ তুলে রাবেয়ার দিকে তাকাতে পারছিলাম না। এমন অবিবেচকের মতো কথা বুঝি শুধু মেয়েদের পক্ষেই বলা সম্ভব। রাবেয়ার চোখ চকচক করছে, কে জানে কেঁদে ফেলবে কিনা। আমি হাত ধরলাম রাবেয়ার।
আমরা যাই খালা, খালুজান কোথায়?
বুকিং-এ কী যেন আলাপ করছেন।
তাকে সালাম দিয়ে দেবেন। খোদা হাফেজ।
কিটকির সঙ্গে গেটে দেখা, তার এক বান্ধবীর সঙ্গে হো হো করে হাসছিল, যাই কিটকি।
সে কি? প্লেন ছাড়তে এখনো চল্লিশ মিনিট।
না রে–একটু সকাল সকাল যেতে হবে, কাজ আছে।
রাবেয়া আপা এমন মুখ কালো করে রেখেছেন কেন?
রাবেয়া থতমত খেয়ে বলল, তুই চলে যাচ্ছিাস, তাই। চিঠি দিবি তো?
রাবেয়া আমার ছ বছরের বড়ো। এ বছর একত্ৰিশে পড়েছে। অথচ কি বাচ্চা মেয়ের মতো হাত ধরে আসছে আমার পিছে পিছে। মাথায় আবার মস্ত ঘোমটাও দিয়েছে। রিক্সায় উঠে জড়সড় হয়ে বসে রইল সে।
রাবেয়া, চুপ করে আছিস যে?
তুই নিজেও তো চুপ করে আছিস।
তুই মুখ কালো করে রাখলে বড়ো খারাপ লাগে! তুই কি মনে কষ্ট পেয়েছিস?
রাবেয়া ফিসফিস্ করে বলল, আমি কখনো কারো কথায় কষ্ট পাই না। আজ খালার কথা শুনে বড়ো খারাপ লাগছে।
নির্জন রাস্তায় রিক্সা দ্রুত চলছে। রিক্সার দুলুনিতে রাবেয়াটা কাঁপছে অল্প অল্প। মাথায় গন্ধ তেল দিয়েছে বুঝি, তার মৃদু সুবাস পাচ্ছি। রাস্তায় কী ধূলো! রাবেয়ার বা হাত অবসন্নভাবে পড়ে আছে আমার কোলে।
খালার কথা এখনো মনে গেথে রেখেছিস, খালার কি মাথার ঠিক আছে?
না, তা নয়। যাই হোক–বাদ দে, , অন্য কথা বল।
কী কথা?
কিটকির জন্য তোর খারাপ লাগছে?
তা লাগছে। যতটা ভাবছিস ততটা নয়।
রাবেয়া অল্প হেসে চুপ করল। তার যে এতটা বয়স হয়েছে, মনেই হয় না। ঐ তো সেদিন যেন কারা দেখতে এল। বুড়ো ভদ্রলোক মাথা দুলিয়ে বললেন, মেয়ে আপনার ভালো, লক্ষ্মী মেয়ে, দেখেই বুঝেছি। বয়সও বেশি নয়, তবে কিনা আজকালকার আধুনিক ছেলে, তাদের কাছে রূপ মানেই হলো ধবধবে ফর্সা। বলেই ভদ্রলোক হায়নার মতো হে হে করে হাসতে লাগলেন।
গান জান মা? কোনো বাজনা? এই ধর গিটার-ফিটার? আজকাল আবার এসবের খুব কদর।
জ্বি না, জানি না।
এবার বরের এক বন্ধু এগিয়ে এলেন।
আপনি কি মডার্ণ লিটারেচার কিছু পড়েছেন?
না, পড়ি নি।
ইবসেনের নাম নিশ্চয়ই শুনেছেন?
জ্বি না, শুনি নি।
বিয়ে ভেঙে গেল। আরো একবার সব কিছু ঠিকঠাক। ছেলেটিও ভালো, অথচ রাবেয়াই বেঁকে বসল।
ও ছেলে বিয়ে করব না।
কোন বল তো? ছেলে দেখে পছন্দ হচ্ছে না?
না-না, পছন্দ হবে না কেন, বেশ ভালো ছেলে।
তবে! বেতন কম পাচ্ছে বলে?
ছিঃ, সে-জন্যে কেন হবে? আর বেতন কমই—বা কি?
ঠিক করে বল তো, অন্য কোনো ছেলেকে ভালো লাগে?
গাধা! সিনেমা দেখে দেখে তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে।
কী জন্যে বিয়ে করবি না, বল।
ছেলেটা বড় বাচ্চা। বয়সে ওর দেড় গুণ বড়ো আমি। আমার ভীষণ লজ্জা করছে। তাছাড়া একটা কথা তোকে বলি খোকা–
বল।
বিয়ে-টিয়ে করতে আমার একটুও ইচ্ছে হয় না। ওটা একটা বাজে ব্যাপার। অজানা-অচেনা একটা ছেলের সঙ্গে শুখে থাকা, ছিঃ।