লোকটি কে রে রাবেয?
রাবেয়া জবাব দেবার আগেই বাবা ঢুকলেন, ভাত দিয়ে যাও মা। সকাল সকাল খেয়ে শুয়ে পড়ি।
আগে চকোলেট খাও বাবা। এই নাও।
কে এনেছে চকোলেট, খোকা তুই নাকি?
না বাবা, আবিদ হোসেন এনেছেন।
বাবা একটু অবাক হয়ে বললেন, দেশে ফিরেছে জানি না তো। এক জার্মান মেয়েকে বিয়ে করেছিল শুনেছিলাম। সেখানেই নাকি থাকবে?
আমি বললাম, আবিদ হোসেন কে বাবা?
আমার এক জন বন্ধুমানুষ। রেলওয়ে ইঞ্জিনীয়ার, খুব ভালো সেতার বাজাতে জানে।
সকাল সকাল খাওয়া সারা হল। একটিমাত্র হ্যারিকেনে চারদিক ভৌতিক লাগছে। আমাদের বড়ো বড়ো ছায়া পড়েছে দেয়ালে। বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টি। ঝড় উঠেছে হয়তো, শোঁ শোঁ আওয়াজ দিচ্ছে। মন্টু বলল, বাবা, গল্প বলেন।
কিসের গল্প, ভূতের?
নিনু বলল, না, আমি ভয় পাচ্ছি, হাসির গল্প বলেন।
বাবা বললেন, রাবেয়া, তুই একটা হাসির গল্প বল।
রাবেয়ার হাসির গল্পটা তেমন জমল না। বাবা অবশ্যি অনেকক্ষণ ধরে হাসলেন।
রুনু বলল, মনে পড়ে। আপা, মা এক দিন এক কানা সাহেবের গল্প বলেছিল? সেদিনও এমন ঝড়-বৃষ্টি।
কোন গল্পটার কথা বলছিস?
ঐ যে, সাহেব বাজারে গেছে গুড় কিনতে।
মনে নেই তো গল্পটা, বল তো।
রুনু চোখ বড়ো বড়ো করে গল্প বলে চলল। রুনুটা অবিকল মায়ের চেহারা পেয়েছে। এই বয়সে হয়তো মা দেখতে এমনিই ছিলেন। কেমন অবাক লাগে–একদিন মা যে— গল্প করে গেছেন, সেই গল্পই তাঁর এক মেয়ে করছে। পরিবেশ বদল হয় নি একটুও, সেদিন ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছিল, আজও হচ্ছে।
গল্প শেষ হতেই বাবা একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। টানা গলায় বললেন, শুয়ে পড় সবাই।
শুয়ে শুয়ে আমার কেবলই মায়ের কথা মনে পড়তে লাগল, বেশ কিছুদিন আগেও এক দিন এরকম মনে পড়েছিল। সেকেণ্ড ইয়ারের ক্লাস নিচ্ছি, হঠাৎ দেখি বারান্দায় একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কার সঙ্গে যেন গল্প করছে। দেখামাত্র ধক করা উঠল। বুকের ভেতর। অবিকল মায়ের মতো চেহারা। তেমনি দাঁড়াবার ভঙ্গি, বিরক্তিতে কুচকে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরা। আমি এত বেশি বিচলিত হলাম যে, ক্লাসে কী বলছি নিজেই বুঝতে পারছিলাম না। ক্লাস শেষ হলেই মেয়েটি সঙ্গে আলাপ করব, এই ভেবে প্ৰাণপণে ক্লাসে মন দিতে চেষ্টা করলাম। ক্লাস একসময় শেষ হল, মেয়েটিকে খুঁজে পেলাম না। সেদিনও সমস্তক্ষণ মায়ের কথা ভেবেছিলাম। সে-রাতে অনেক দিন পর স্বপ্ন দেখলাম মাকে। মা ছোট্ট খুকি হয়ে গেছেন। ফ্রক পরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন্ন ঘরময়। আমি বলছি, মা আপনি এত হৈচৈ করবেন না, আমি ঘুমুচ্ছি।
মা বললেন, বা রে, আমি বুঝি এক্কা-দোক্কাও খেলব না?
খেলুন, তবে শব্দ করে নয়।
তুই খেলবি আমার সঙ্গে খোকা?
না, আমি কত বড়ো হয়েছি দেখছেন না? আমার বুঝি এসব খেলতে আছে?
খুব অবাক হয়েছিলাম স্বপ্নটা দেখে। এমন অবাস্তব স্বপ্নও দেখে মানুষ!
মায়ের চারদিকের রহস্যের মতো স্বপ্নটাও ছিল রহস্যময়। চারদিকে রহস্যের আবরণ তুলে তিনি আজীবন আমাদের চেয়ে আলাদা হয়ে ছিলেন। শুধু কি তিনিই? তাঁর পরিবারের অন্য মানুষগুলিও ছিল ভিন্ন জগতের মানুষ, অন্তত আমাদের কাছে।
মাঝে-মাঝে বড়ো মামা আসতেন বাসায়। বাবা তটস্থ হয়ে থাকতেন সারাক্ষণ। দৌড়ে মিষ্টি আনতে যেতেন। রাবেয়া গলদঘর্ম হয়ে চা করত, নিমকি ভাজিত। বড় মামা সিকি কাপ চা আর আধখানা নিমকি খেতেন। যতক্ষণ থাকতেন, অনবরত পা নাচাতেন আর সিগারেট ফুকতেন। আমাদের দিকে কখনো মুখ তুলে তাকিয়েছেন বলে মনে পড়ে না। বাবা অবশ্যি এক এক করে আমাদের নিয়ে যেতেন তাঁর সামনে। আমরা নিজেদের নাম বলে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। মামা ভীষণ অবাক হয়ে বলতেন, এরা সবাই শিরিনের ছেলেমেয়ে? কী আশ্চর্য! আশ্চর্যটা যে কী কারণে, তা বুঝতে না পেরে আমরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করতাম। মামা রুমাল দিয়ে ঠোঁট মুছতে মুছতে বলতেন, বুঝলেন আজহার সাহেব, শিরিন ছোটবেলায় মোটেই ছেলেমেয়ে দেখতে পারত না। আর তারই কিনা এতগুলি ছেলেমেয়ে!
এই যে, এইটিই কি বড়ো ছেলে?
মামা আঙুল ধরে রাখতেন আমার দিকে। আমি ঘাড় নাড়াতাম।
মামা বলতেন, কী পড়া হয়?
নাইনে পড়ি।
বাবা অতিরিক্ত রকমের খুশি হয়ে বলতেন, খোকা এইটের বৃত্তি পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়েছে। জ্বর নিয়ে পরীক্ষা দিয়েছিল। স্কুল থেকে একটা মেডেল দিয়েছে। গোন্ড মেডেল। রাবেয়া, যাও তো মা, মেডেলটা তোমার মামাকে দেখাও। ছোট ট্রাঙ্কে আছে।
ব্লেডের মতো পাতলা মেডেলটা মামা ঘুরিয়েফিরিয়ে দেখতেন। আবেগশূন্য গলায় বলতেন, শিরিনের মতো মেধাবী হয়েছে ছেলে। শিরিন মেট্রিকুলেশনে মেয়েদের মধ্যে প্রথম হয়েছিল।
বলতে বলতে মামা গম্ভীর হয়ে যান। অপ্রাসঙ্গিক ভাবে বলেন, আমাদের পরিবারটাই ছিল অন্য ধরনের। হাসিখুশি পরিবার। বাড়ির নাম ছিল কারা কানন। দেয়ালের আড়ালে ফুলের বাগান। শিরিন নিজেই দিয়েছিল নাম।
মা আসতেন আরো কিন্তু পরে। খুব কম সময় থাকতেন। আমরা বেরিয়ে আসতাম। সবাই। একসময় দেখতাম মুখ কালো করে মামা উঠে যেতেন। মা শুয়ে শুয়ে কাঁদতেন। সারা দুপুর। আমরা মনমরা হয়ে ঘুরে বেড়াতাম। কিছুই ভালো লগত না। সেই অল্পবয়সেই মাকে কি গভীর ভালোই না বেসেছিলাম! অথচ তিনি ছিলেন খুবই নিরাসক্ত ধরনের। কথাবার্তা বলতেন কম। নিঃশব্দে হাঁটতেন। নিচু গলায় কথা বলতেন। মাঝে মাঝে মনে হত, বড়ো রকমের হতাশায় ড়ুবে গেছেন। তখন সময় কাটাতেন বিছানায় শুয়ে শুয়ে। প্রয়োজনের কথাটিও বলতেন না। ঘরের কাজ রাবেয়া আর একটা ঠিকে ঝি মিলে করত। বিষন্নতায় ড়ুবে যেত সারা বাড়ি। বাবা অফিস থেকে এসে চুপচাপ বসে থাকতেন বারান্দায়। রাবেয়া চা এনে দিত। বাবা ফিস্ফিস্ করে বলতেন, তোর মাকে দিয়েছিস?