ঘোড়া উঠানে দাঁড়িয়ে থাকে। ঝড়-তুফান দুই ভাই মহানন্দে ঘোড়ার পিঠে বসে থাকে। এদের আনন্দ দূর থেকে দেখে পরী। আনন্দে তার চোখেও পানি আসে। সে তার জীবনের আনন্দ-সংবাদ জানিয়ে লীলাবতীকে একটি চিঠিও লিখেছে—
বুবু,
শত সহস্ৰ সালাম। নিবেদন আমরা সকলে মঙ্গলমতো আছি। তুফান কিছুদিন কাশিতে কষ্ট পাইয়াছে। বাসক পাতার রস খাইবার পর আরোগ্য হইয়াছে। ঝড় মাশাল্লাহ ভালো আছে। অসুখ-বিসুখ তার তেমন হয় না।
এইদিকে আমি ঘর-দুয়ার গুছাইবার চেষ্টা করতেছি। আপনার মামাকে আপনি চিনেন। তিনি বিনা কাজের কাজি। সকাল হইতে নিশিরাত পর্যন্ত কর্ম ছাড়াই অতি ব্যস্ত। লাটিমের মতো ঘূর্ণনের মধ্যে আছেন। নিজের বিষয়-সম্পত্তি কী আছে কিছুই জানেন না। আমি এখানে না আসিলে সমস্তই দশভূতে লুটিয়া খাইত।
তাহার বিষয়-সম্পত্তি খারাপ না, ভালোই। বাড়ির পেছনের বাগানে সুপারি গাছ আছে একচল্লিশটা। কাঁঠাল গাছ সতেরোটা, আম গাছ সাতটা, পেয়ারা গাছ আঠারোটা।
আপনি নিশ্চয়ই আমার পত্র পাঠ করিয়া হাসিতেছেন এবং আপনার ধারণা হইয়াছে, আমার বর্তমান কাজ গাছ গোনা। ইহা সত্য। আমি এখন উনার কী আছে না আছে তাহা নিয়াই ব্যস্ত। উনার প্রতিটি জিনিসই মনে হয় আমার জিনিস। আপনাদের বিশাল ভূ সম্পত্তি দেখিয়া আসিয়াছি। তাহার কোনো কিছুই আমার আপন মনে হয় নাই। বুরু, আমার কথায় মনে কষ্ট নিবেন না।
আপনার মঞ্জু মামার মা মৃত্যুকালে প্রচুর গয়না রাখিয়া গিয়াছিলেন। উনি কিছুই জানিতেন না। পুরাতন বাক্স পোটলা পুঁটলি ঘাঁটিতে ঘাটিতে আমি তার সন্ধান পাই। স্যাকরা আনাইয়া গয়না ওজন করাইয়াছি। সর্বমোট ছাপ্পান্ন ভরি সোনার গয়না আছে।
বুবু, আপনি জাইতরী-কইতরীকে নিয়া কোনো দুশ্চিন্তা করিবেন না। দুইবোন ভালো আছে। আনন্দে আছে। আপনার মামা বাড়ির পেছনের বাগানে দুই বোনের জন্য দুইটি খড়ের চালা নির্মাণ করিয়াছেন। একটির নাম দিয়াছেন কইতর মহল। অন্যটির নাম দিয়াছেন জাইতর মহল। দুইবোন দিনের বেশিরভাগ সময় এই দুই চালাতে থাকে।
আপনার মঞ্জু মামার বাড়িতে পানির ভালো ব্যবস্থা ছিল না। আমি একটি টিউবওয়েল বসাইয়াছি। আল্লাহর মেহেরবানি, টিউবওয়েলের পানি অতি সুস্বাদু প্রমাণিত হইয়াছে। নিজেদের বাড়িতে টিউবওয়েল থাকা সত্ত্বেও অনেকে আমাদের টিউবওয়েলের পানি নিতে আসে। এই বাড়িতে একটি কুয়া ছিল। সংস্কারের অভাবে কুয়া বুজিয়া গিয়াছিল। আমি ঠিক করাইয়াছি এবং কুয়াতলা বাঁধাইয়া দিয়াছি। জায়গাটা এখন অতি মনোরম হইয়াছে।
বুবু, আপনাকে লেবু বাগানের কথা বলিতে ভুলিয়া গিয়াছি। লেবু বাগান আমার শাশুড়ির নিজের হাতে করা। সারা বৎসর বাগানে লেবু থাকে। বাড়ির সামনের পুকুরের পাড়ে আমার শাশুড়ির হাতে লাগানো নারিকেল গাছ আছে ত্ৰিশটা। প্রতিটা গাছই ফলবতী। আগে ডাব-নারিকেল দশ ভূতে নিয়া যাইত। এখন আর হইতেছে না। পুকুরের চার দিকে কাঁটাতারের বেড়া দিবার সিদ্ধান্ত নিয়াছি। ইনশাল্লাহ আগামী বর্ষার আগেই কাৰ্য সমাধা করিব।
বুবু, অনেক কথা লিখিয়া ফেলিয়াছি। পত্রে কোনো ভুল-ত্রুটি করিয়া থাকিলে ক্ষমা দিবেন।
ইতি— আপনার স্নেহের হতভাগিনী
পরীবানু।
আমরা সবাই অপেক্ষা করি
লীলাবতী মূল বাড়ির উঠানে বসে আছে। সে মজার একটা দৃশ্য দেখছে। তার সামনে হাত পঁচিশেক দূরে একটা কাঁঠালগাছ। কাঁঠালগাছের নিচে গর্তমতো হয়েছে। বর্ষার পানি জমেছে। গর্তে। সেই পানিতে একটা কাক গোসল করছে। গোসল সারছে অতি ব্যস্ততায়। ঠোঁটে পানি নিয়ে পালকে মাখছে। কাকের স্নান মুগ্ধ হয়ে দেখার কিছু না। অস্বাভাবিক কোনো দৃশ্য না। সব পাখিই স্নান করে। তবে কাকের বিশেষত্ব তার তাড়াহুড়ায়। কাকের স্নান দেখলে মনে হয়, জরুরি কোনো কাজ ফেলে সে এসেছে, তাকে অতি দ্রুত চলে যেতে হবে। তারপরেও এই দৃশ্যটা লীলাবতী মুগ্ধ চোখে দেখছে অন্য কারণে। কাকের স্নান দেখার জন্যে অন্য আরেকটা কাক পাশে বসে আছে। সে ঘাড় বাঁকিয়ে আছে এবং মাঝে মাঝে কা কা করছে।
লোকমান এসে লীলাবতীর পাশে দাঁড়াল। লীলাবতী বলল, লোকমান ভাই, আপনি পুরুষ কাক কোনটা আর মেয়ে কাক কোনটা বুঝতে পারেন? যে কাকটা গোসল করছে সে ছেলে না মেয়ে?
লোকমান না-সূচক মাথা নাড়ল।
লীলাবতী বলল, মাথা নেড়ে। আপনি কী বোঝাতে চাচ্ছেন? আপনি জানেন না?
জানি না।
আমার ধারণা যে কাকটা গোসল করছে সেটা মেয়ে কাক। দেখুন। সাইজে ছোট।
কিছু খাবেন আপা?
না।
আজি দুপুরে কি জঙ্গলে খাবেন?
তাও জানি না। এখন আপনি সামনে থেকে যান। আপনাকে সবসময় আমার চোখের সামনে থাকতে হবে না।
লোকমান সরে গেল। লীলাবতী আবার তাকালো কাকটার দিকে। প্রথম কাকটার গোসল হয়ে গেছে, এখন দ্বিতীয় কাকটা গোসল করছে। এটাও মনে হয় বিস্মিত হবার মতো ঘটনা। গর্তটা দুটা কাকের একসঙ্গে গোসল করার মতো বড় ছিল। তারা তা করল না কেন? তাদের মধ্যেও কি সৌজন্য বোধের কোনো ব্যাপার আছে?
লীলাবতী উঠে দাঁড়াল। হাঁটতে শুরু করল স্নানরত কাকটার দিকে। তাকে দেখলে একসময় তারা দুজন ভয় পেয়ে উড়ে চলে যাবে। ভয়টা কখন পাবে এটা তার পরীক্ষা করার ইচ্ছা। সব পাখি মানুষকে সমান ভয় পায় না। কোনো পাখি হয়তো তার দশ গজের কাছাকাছি আসতে দেবে। আবার কেউ দেবে পাচি গজ পর্যন্ত। পাখিদের ভয়ের একটা স্কেল তৈরি করা যেতে পারে।