হাওলু মিয়া শোনো, কাজকর্মের চাপ একটু কমলে তোমারে আমাদের অঞ্চলে নিয়া যাব। আহারে কী জায়গা! কী বিরাট বাড়ি চাচাজির! মূল বাড়ি, উত্তর বাড়ি, শহর বাড়ি। তয় ভূতের উপদ্ৰব।
ভূতের উপদ্রব?
ছোট বাড়িতে ভূতের উপদ্ৰব থাকে না। বড় বড় সব বাড়িতে জিন-ভূত থাকে। অনেক ঘর থাকে খালি, এরা আশ্রয় নেয়।
আপনে জিন-ভূত দেখছেন?
চাচাজির বাড়িতে থাকব, জিন-ভূত দেখব না। এইটা হয়!
ভয় পাইছেন?
নাহ্। রোজ রাতে দেখলে ভয় থাকে না। দেখতে চাইলে তোমারে দেখাব। কোনো অসুবিধা নাই। বেশি ভয় পাইলে আয়াতুল কুরসি পইড়া ফু দিবা। আয়াতুন কুরসি জানো তো?
জি না।
শিখা নিবা। আয়াতুল কুরসি মুখস্থ না করলে তোমারে নিয়া যাব না। কখন কী বিপদ হয়! বিবাহ করেছ?
জি না।
ইচ্ছা করলে আমাদের অঞ্চলে বিবাহ করতে পারো। আমাদের অঞ্চলের মেয়ে অত্যধিক সুন্দর। তাদের আদব-লোহাজও ভালো। আমি ব্যবস্থা করে দিব। আমার এককথায় বিবাহ হয়ে যাবে। চাচাজির সঙ্গে কাজ করেছি। তো। আমাদের ইজ্জতই অন্যরকম। কেউ কোনো কথা ফেলব না।
হাওলু মুগ্ধ হয়ে শোনে। অতি আশ্চর্য সেই ভাটি অঞ্চলে তার যেতে ইচ্ছা করে।
মঞ্জু বাগদীর বাজারের হাট থেকে একটা ঘোড়া কিনেছেন! গাধা ধরনের ঘোড়া। সাইজে ছোট। গাধার মতোই লম্বা লম্বা কান। হাঁটা-চলার আগ্রহ খুবই কম। সে তার চার ঠ্যাঙ মাটিতে পুতে দাঁড়িয়ে থাকে। লাগাম ধরে টানাটানি, পিঠে বাড়ি কিছুতেই কাজ হয় না।
পরীবানু বিরক্ত। সে বেজার মুখে বলল, এটা কী ঘোড়া কিনেছেন। গাধা মার্কা ঘোড়া।
মঞ্জু বলেছেন, গাধা মার্কা ঘোড়াই দরকার। আমি গাধা মার্কা লোক। আমার ঘোড়াও গাধা মার্কা।
ঘোড়া কেনার আপনার দরকারটা কী ছিল?
দরকার আছে বলেই কিনেছি। বিনা দরকারে আমি কিছু করি না। ঘোড়া আমি তোমার জন্যেও কিনি নাই। আমার জন্যেও কিনি নাই। ঝড়-তুফানের জন্যে কিনেছি। এরা ঘোড়ায় চড়া শিখবে। এরা দুইজন হেজি-পেজি না। এরা সিদ্দিক সাহেবের নাতি।
ঘোড়া উঠানে দাঁড়িয়ে থাকে। ঝড়-তুফান দুই ভাই মহানন্দে ঘোড়ার পিঠে বসে থাকে। এদের আনন্দ দূর থেকে দেখে পরী। আনন্দে তার চোখেও পানি আসে। সে তার জীবনের আনন্দ-সংবাদ জানিয়ে লীলাবতীকে একটি চিঠিও লিখেছে—
বুবু,
শত সহস্ৰ সালাম। নিবেদন আমরা সকলে মঙ্গলমতো আছি। তুফান কিছুদিন কাশিতে কষ্ট পাইয়াছে। বাসক পাতার রস খাইবার পর আরোগ্য হইয়াছে। ঝড় মাশাল্লাহ ভালো আছে। অসুখ-বিসুখ তার তেমন হয় না।
এইদিকে আমি ঘর-দুয়ার গুছাইবার চেষ্টা করতেছি। আপনার মামাকে আপনি চিনেন। তিনি বিনা কাজের কাজি। সকাল হইতে নিশিরাত পর্যন্ত কর্ম ছাড়াই অতি ব্যস্ত। লাটিমের মতো ঘূর্ণনের মধ্যে আছেন। নিজের বিষয়-সম্পত্তি কী আছে কিছুই জানেন না। আমি এখানে না আসিলে সমস্তই দশভূতে লুটিয়া খাইত।
তাহার বিষয়-সম্পত্তি খারাপ না, ভালোই। বাড়ির পেছনের বাগানে সুপারি গাছ আছে একচল্লিশটা। কাঁঠাল গাছ সতেরোটা, আম গাছ সাতটা, পেয়ারা গাছ আঠারোটা।
আপনি নিশ্চয়ই আমার পত্র পাঠ করিয়া হাসিতেছেন এবং আপনার ধারণা হইয়াছে, আমার বর্তমান কাজ গাছ গোনা। ইহা সত্য। আমি এখন উনার কী আছে না আছে তাহা নিয়াই ব্যস্ত। উনার প্রতিটি জিনিসই মনে হয় আমার জিনিস। আপনাদের বিশাল ভূ সম্পত্তি দেখিয়া আসিয়াছি। তাহার কোনো কিছুই আমার আপন মনে হয় নাই। বুরু, আমার কথায় মনে কষ্ট নিবেন না।
আপনার মঞ্জু মামার মা মৃত্যুকালে প্রচুর গয়না রাখিয়া গিয়াছিলেন। উনি কিছুই জানিতেন না। পুরাতন বাক্স পোটলা পুঁটলি ঘাঁটিতে ঘাটিতে আমি তার সন্ধান পাই। স্যাকরা আনাইয়া গয়না ওজন করাইয়াছি। সর্বমোট ছাপ্পান্ন ভরি সোনার গয়না আছে।
বুবু, আপনি জাইতরী-কইতরীকে নিয়া কোনো দুশ্চিন্তা করিবেন না। দুইবোন ভালো আছে। আনন্দে আছে। আপনার মামা বাড়ির পেছনের বাগানে দুই বোনের জন্য দুইটি খড়ের চালা নির্মাণ করিয়াছেন। একটির নাম দিয়াছেন কইতর মহল। অন্যটির নাম দিয়াছেন জাইতর মহল। দুইবোন দিনের বেশিরভাগ সময় এই দুই চালাতে থাকে।
আপনার মঞ্জু মামার বাড়িতে পানির ভালো ব্যবস্থা ছিল না। আমি একটি টিউবওয়েল বসাইয়াছি। আল্লাহর মেহেরবানি, টিউবওয়েলের পানি অতি সুস্বাদু প্রমাণিত হইয়াছে। নিজেদের বাড়িতে টিউবওয়েল থাকা সত্ত্বেও অনেকে আমাদের টিউবওয়েলের পানি নিতে আসে। এই বাড়িতে একটি কুয়া ছিল। সংস্কারের অভাবে কুয়া বুজিয়া গিয়াছিল। আমি ঠিক করাইয়াছি এবং কুয়াতলা বাঁধাইয়া দিয়াছি। জায়গাটা এখন অতি মনোরম হইয়াছে।
বুবু, আপনাকে লেবু বাগানের কথা বলিতে ভুলিয়া গিয়াছি। লেবু বাগান আমার শাশুড়ির নিজের হাতে করা। সারা বৎসর বাগানে লেবু থাকে। বাড়ির সামনের পুকুরের পাড়ে আমার শাশুড়ির হাতে লাগানো নারিকেল গাছ আছে ত্ৰিশটা। প্রতিটা গাছই ফলবতী। আগে ডাব-নারিকেল দশ ভূতে নিয়া যাইত। এখন আর হইতেছে না। পুকুরের চার দিকে কাঁটাতারের বেড়া দিবার সিদ্ধান্ত নিয়াছি। ইনশাল্লাহ আগামী বর্ষার আগেই কাৰ্য সমাধা করিব।
বুবু, অনেক কথা লিখিয়া ফেলিয়াছি। পত্রে কোনো ভুল-ত্রুটি করিয়া থাকিলে ক্ষমা দিবেন।
ইতি— আপনার স্নেহের হতভাগিনী
পরীবানু।
পরীবানুর চিঠি
মঞ্জু তাঁর স্ত্রী এবং ঝড়-তুফানকে নিয়ে নিজ গ্রামে ফিরে গেছেন। লীলাবতীকে বলেছেন, মা, আমি তো ঘরজামাই না। ঘরজামাই হলে ভিন্ন কথা ছিল। আমি এখন একা না, আমার স্ত্রী আছে, দুই পুত্ৰ আছে।