লীলা বলল, আমি আপনার জন্যে মউত ঘর বানাব না। আপনার যদি মৃত্যু হয় এই বাড়িতে হবে। আপনার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আমি আপনার সেবা করব।
মাগো, অতি ভয়ঙ্কর মৃত্যু আমার জন্যে অপেক্ষা করতেছে। আমি চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতেছি।
রমিলার শেষ ভবিষ্যৎবাণী ফলে নি। তিনি কার্তিক মাসের তিন তারিখ নিজ বিছানায় শুয়ে মারা গেছেন। সামান্যতম মৃত্যুযন্ত্রণাও তার হয় নি। তাঁর ঠোঁটে লেগে থাকা হাসি দেখে মনে হচ্ছিল, জীবনের শেষপ্রান্তে এসে তার মনে হয়েছে রঙ্গে ঢং-এ জীবনটা তো ভালোই পার করলাম।
লীলা তার মায়ের মৃত্যুর বিষয়ে লিখল— মৃত্যুর সময় আমি তাঁর পাশে ছিলাম। সেদিনই তিনি নতুন সাবান দিয়ে গোসল করে নতুন শাড়ি পরলেন। লজ্জিত গলায় আমাকে বললেন, কাঁচা সুপারি, খয়ের আর চুন দিয়ে একটা পান খাব মা। ঠোঁট লাল করব। আমি পান এনে দিলাম। উনি বললেন, চুনটা ভালো না। শঙ্খ চুন আনায়ে দেও। শঙ্খ চুন আনতে বাজারে লোক গেল। আমি বললাম, আজ মনে হয় আপনি ভালো বোধ করছেন। আসুন বাগানে গিয়ে বসি। তিনি বললেন, না। তারপরই তাঁর মধ্যে সামান্য অসুস্থতা দেখা গেল। তিনি বললেন, আমার মাথাটা তোমার কোলে নাও। আমি তার মাথা কোলে নিলাম। তিনি অস্পষ্ট স্বরে বললেন, আল্লাহপাক আমার অপরাধ ক্ষমা করেছেন। আমি বললাম, মা, আপনি তো কোনো অপরাধ করেন নাই। অপরাধের ক্ষমার প্রশ্ন আসছে কেন?
তিনি হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, সব মানুষই অপরাধের মধ্যে বাস করে গো মা। পায়ের নিচে পড়ে পিঁপড়া মারা যায়, সেটাও তো অপরাধ। আমার বিরাট ভাগ্য আল্লাহপাক আমার সব অপরাধ ক্ষমা করেছেন। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর মৃত্যু হয়। আমি এত সহজ এবং এত সুন্দর মৃত্যু আগে কখনো দেখি নি। ভবিষ্যতে কোনো দিন দেখব তাও মনে হয় না।
মঞ্জু নিজ গ্রামে ফিরে গেছেন
মঞ্জু তাঁর স্ত্রী এবং ঝড়-তুফানকে নিয়ে নিজ গ্রামে ফিরে গেছেন। লীলাবতীকে বলেছেন, মা, আমি তো ঘরজামাই না। ঘরজামাই হলে ভিন্ন কথা ছিল। আমি এখন একা না, আমার স্ত্রী আছে, দুই পুত্ৰ আছে।
লীলাবতী বলল, পরী কি আপনার সঙ্গে যেতে চায়?
মঞ্জু বিরক্ত হয়ে বললেন, তার আবার চাওয়া-চাওয়ি কী? আমি যেখানে যাব সেও সেখানে যাবে।
দেখা গেল পরীবানু শুধু যে একা যেতে চাচ্ছে তা-না জাইতরী-কইতরী দুই বোনও যেতে চাচ্ছে। লীলাবতী বলল, তোমরা কেন যাবে?
কইতরী জবাব দিল না। জাইতরী বলল, আমি যাব।
লীলাবতী বলল, কেন?
জইতরী মাটির দিকে তাকিয়ে রইল। জবাব দিল না। মঞ্জু বললেন, আমার অঞ্চলে ভালো স্কুল আছে। আমি তাদের স্কুলে ভর্তি করে দিব। চোখে চোখে রাখব। এইখানে তুই ছাড়া আর কে আছে? তুই নিজেও তো সারাজীবন থাকবি না। তোর বিয়ে হবে। তুই চলে যাবি স্বামীর সংসারে। এই দুই মেয়ে এত বড় জায়গায় একা একা ঘুরবে? এটা তোর কেমন বিবেচনা?
লীলাবতী চুপ করে গেল। তার একবার বলতে ইচ্ছা করছিল, মামা, তোমার যুক্তি মানলাম। কিন্তু আমি এখানে একা পড়ে থাকব এটা তোমার কেমন বিবেচনা? সে কিছু বলল না।
মঞ্জুর সঙ্গে যাবার জন্যে আরো দুজন তৈরি হলো। একজন বদু আরেকজন নিরঞ্জন। বদু বলল, আপনি যেখানে আমি সেখানে। এখন আমারে মারেন কাটেন আপনের বিষয়। নিরঞ্জন কিছু বলল না। সে বিনা প্রয়োজনে কথা বলে না। যাওয়া বিষয়ে কোনো কথা বলার প্রয়োজন সে বোধ করছে না। মঞ্জু ঠিক করেছেন, নিরঞ্জনকে নিয়ে তিনি একটা ভাতের হোটেল দিবেন। হোটেলের নাম দিবেন। হিন্দু-মুসলিম হোটেল। হোটেলের একজন বাবুর্চি নিরঞ্জন, আরেকজন তিনি নিজে। আগের মতো দিন কাটালে এখন হবে না। আয়-রোজগারের পথ দেখতে হবে। ছিলেন একা মানুষ, হুট করে সংসার বড় হয়েছে। সংসারে এখন আটজন মানুষ। ঝড়-তুফান। ঝড়-তুফানের মা। জাইতরী-কইতরী। বদু এবং নিরঞ্জন। এর মধ্যে বদু একাই তিনজনের ভাত খায়।
মঞ্জুর ভাতের হোটেল চালু হয়েছে। হোটেলের নাম হিন্দু-মুসলিম হোটেল না। পরীবানু এই নাম রাখতে দেয় নি। পরীবানুর যুক্তি হলো, হিন্দু-মুসলিম হোটেল নাম দিলে হিন্দুও সেই হোটেলে যাবে না, মুসলমানও যাবে না। মঞ্জু পরীবানুর যুক্তিতে মোহিত হলেন। হোটেলের নাম হলো আদর্শ হোটেল। মঞ্জু তার স্বভাব মতো এক সপ্তাহ হোটেল দেখেছেন। এখন আর কিছু দেখছেন না। এখন দেখছে পরীবানু। সে ভালোভাবেই দেখছে। হোটেল ভালো চলছে। হাটের দিনে তিনবার হাঁড়ি চড়াতে হয়। হোটেলের ভেতর কাস্টমারদের জায়গা দেওয়া যায় না। কাস্টমাররা থালা হাতে হোটেলের বাইরে বসে যায়। তিন আইটেম রান্না হয়— ভাজি, ডাল, মাংস। মাছের কোনো আইটেম এখনো চালু করা হয় নি। এর পেছনেও পরীবানুর হাত আছে। পরীবানুর যুক্তি— মাছ সবাই বাড়িতেই খায়। হোটেল-রেন্টুরেন্টে সবাই মাংস খেতে চায়।
হোটেলের বাজার এবং টাকা-পয়সার হিসাবের দায়িত্বে আছে বদু। আগে তার দিন কেটেছে শুয়ে-বসে, এখন সে নিঃশ্বাস ফেলার ফুরসূতও পাচ্ছে না। রাত নটায় হোটেল বন্ধ করে সে ঘরে ফিরে। তার সঙ্গে হোটেলের এক কর্মচারীও। (মিলন হাওলাদার, ডাক নাম হাওলু মিয়া) আসে। যার কাজ হচ্ছে, বদুর গায়ে তেল ডলা। একসময় বদুর দিন কাটত অন্যের গায়ে তেল ডলাডলি করে, এখন অন্য একজন তার গায়ে তেল ডলাডলি করছে। জীবনের এই উত্থানে সে চমৎকৃত।
রাতে তেল ডলাডলির অংশটা সে বড়ই উপভোগ করে। হাওলু মিয়া কাজটা করেও চমৎকার। সরিষার তোলে রসুন দিয়ে জ্বাল দেয়। সেই তেলের বাটি হারিকেনের উপর দিয়ে রাখে। তেল থাকে গরম। গরম তেল গায়ে ডলা হয়। আরামে বন্দুর চোখ বন্ধ হয়ে আসে। চোখ বন্ধ করে নানান গল্প করতে তার বড় ভালো লাগে।