জি না।
তাহলে আমার কাছ থেকে শোনো। পারস্যের এক সম্রাট ছিলেন, নাম শাহ আব্বাস। উনি ছিলেন মহান সম্রাট। সারাজীবন তিনি বড় বড় কাজ করে গেছেন। তারপর থেকে কেউ যদি বড় কোনো কাজ করত বা ভালো কাজ করত সবাই বলত— আরো এই লোক দেখি শাহ আব্বাসের মতো! সেখান থেকে হলো সাবাস। কেউ ভালো বা বড় কিছু করলেই আমরা বলি সাবাস।
এই গল্প আপনাকে কে বলেছে?
আনিস মাস্টার বলেছে। তার কাছ থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি। মাগো শোনো, আনিস মাস্টারের মামলা কোর্টে উঠতেছে বলে খবর পেয়েছি। এই মামলার যাবতীয় খরচ আমি দিব। তুমি ব্যবস্থা করো।
আমি যা করার করব।
তোমার মা, সে কেমন আছে? সত্য কথা বলবা। আমি বুঝদার মানুষ। আমাকে বুঝা দেওয়ার কিছু নাই।
উনার শরীর ভালো না। শরীর খুবই খারাপ। তবে মাথা এখন ঠিক আছে। চিন্তা-ভাবনা পরিষ্কার।
আলহামদুলিল্লাহ। শরীরের সুস্থতা কোনো বিষয় না মা। মনের সুস্থতাই সুস্ততা।
রমিলাকে মূল বাড়ি থেকে শহরবাড়িতে নেয়া হয়েছে। তার সেবার সব দায়দায়িত্ব নিয়েছে পরীবানু। কাজটা সে করে কঠিন শৃঙ্খলায়। একটুও এদিকওদিক হবার উপায় নেই। প্রতিদিন দুপুরে কর্পূর মেশানো গরম পানি দিয়ে গোসল। এই গোসল রমিলাকে করতেই হবে। একবেলার জন্যেও বাদ যাবে। না। গায়ে জ্বর থাকলেও বাদ যাবে না। বিকালে পাকা পেঁপে। পরীবানু মুখে তুলে পেঁপে খাওয়াবে। সেখানেও না করা যাবে না। খাওয়া-খাদ্যের হাত থেকে বাচার জন্যে রমিলা প্রায়ই নানান কৌশল করেন। কোনো কৌশলই কাজ করে না। একদিন তিনি বললেন, মাগো, তোমাকে একটা সিমাসা দেই। যদি সিমাসা ভাঙাতে পারো তাহলে খাব। ভাঙাতে না পারলে খাব না। সিমাসাটা হলো—
নাই পুষকুনির নাই জলে
নাই পদ্ম ফোটে
কও দেখি জিনিসটা কী
বুদ্ধি থাকলে ঘটে।
পরীবানু বলল, আমার ঘটে কোনো বুদ্ধি নাই। একটা বুদ্ধি আছে, আপনি না খাওয়ার মতলব করছেন। লাভ নাই, হাঁ করেন।
রাতে পরীবানু ঘুমায় রমিলার সঙ্গে। রমিলা নানান বিষয়ে কথা বলেন। কিন্তু একবারও জানতে চান না সিদ্দিকুর রহমান মানুষটার কী হলো। তিনি কোথায় আছেন কীভাবে আছেন। লীলা একদিন বলল, মা, চলেন। আপনাকে বাবার সঙ্গে দেখা করিয়ে আনি। তিনি সঙ্গে সঙ্গে গুটিয়ে গিয়ে বললেন, নাগো মা, না।
লীলা বলল, না কেন?
মানুষটাকে আমি সারাজীবন দেখেছি মাঠে ময়দানে, খোলা জায়গায়। আইজ সে তালাবন্ধ, এইটা দেখতে মন চায় না।
মা, আপনার কি মানুষটার জন্যে খারাপ লাগে না?
রমিলা লীলাকে বিস্মিত করে দিয়ে বললেন, সেই রকম খারাপ লাগে না।
কেন সেই রকম খারাপ লাগে না?
মানুষটা হিসাবের মধ্যে পড়ছে, এই জন্যে খারাপ লাগে না।
বুঝিয়ে বলেন। হিসাবের মধ্যে পড়েছে মানে?
রমিলা শান্ত গলায় বললেন, আল্লাহপাক হিসাবে দুনিয়া চালান। তাঁর হিসাবে ক্ৰটি নাই। মাসুদরে তোমার পিতা তালাবন্ধ করছিল, আল্লাহপাক সেই হিসাবে উনাকে তালাবন্ধ করেছেন। মাসুদ চলে গেছে, আল্লাহপাক সেই হিসাব করে আরেকজনরে উপস্থিত করেছেন, তার নাম মঞ্জু।
আপনার মতো চিন্তা করতে পারলে সুখে থাকতে পারতাম।
তুমি যে আমার মতো চিন্তা করবা না, সুখে থাকবা না— এইটাও আল্লাহ পাকের হিসাব।
লীলা বলল, মা, আপনি তো ভবিষ্যৎ বলতে পারেন, এই মামলার রায় কী হবে বলতে পারেন?
রমিলা বললেন, কোরান মজিদে আল্লাহপাক বলেছেন– নাসরুম মিনাল্লাহি ওয়া ফাতহুন কারিব।
এর অর্থ কী?
এর অর্থ, আল্লাহ তাদের বিজয় দান করেন, যারা এর উপযুক্ত। আমার হুজুরের এই আয়াতটা খুব পছন্দ ছিল। হুজুরের কথা তো তোমাকে বলেছি। বলি নাই?
বলেছেন। এখন বলুন বাবা কি বিজয়ের উপযুক্ত?
সেই বিবেচনা আল্লাহপাক করবেন। হিসাব তাঁর কাছে।
পরীবানুর সঙ্গে এখন তার প্রবল সখ্য হয়েছে। প্রায়ই নিশিরাতে তিনি ধাক্কা দিয়ে পরীবানুর ঘুম ভাঙান। পরীবানু আতঙ্কিত গলায় বলেন, মা, শরীর ঠিক আছে? কোনো অসুবিধা?
রমিলা চাপা গলায় বলেন, কোনো অসুবিধা নাই। তুমি একটা গীত করো। শুনি।
পরীবানু প্ৰায় সঙ্গে সঙ্গেই গীত ধরে—
পীরিতের ভাঙা নাও
নিয়া বান্ধই কোথায় যাও
কোন পবনে নাম লেখাও
দেখাও যৈবনের বাহার।।
গান শুনতে শুনতে রমিলা হাত রাখেন। পরীবানুর পিঠে। নিজে গানের তালে তালে মাথা দোলাতে শুরু করেন। একসময় ক্ষীণ এবং অস্পষ্ট স্বরে তিনিও পরীবানুর সঙ্গে গাইতে থাকেন— দেখাও যৈবনের বাহার।
পরীবানু গান শেষ করে বলে, মা, খুশি হয়েছেন?
রমিলা বলেন, তোমার সকল কর্মকাণ্ডেই আমি খুশি। আমার যদি বিষয়সম্পত্তি থাকত সব তোমারে দিয়া যাইতাম। আমার কিছুই নাই।
আপনার এমন এক জিনিস আছে যা অন্য কারোর নাই, সেইটা আমারে দিয়া যান।
কোন জিনিসগো মা?
ভবিষ্যৎ বলার ক্ষমতা। এইটা আমারে দিয়া যান।
হাতে থাকলে দিতাম। আমার হাতে নাই।
আশ্বিন মাসের এক মধ্যরাতে রমিলা লীলাকে ডেকে পাঠালেন। শান্ত গলায় বললেন, মাগো শোনো, আমার দাদি শাশুড়ির মৃত্যু যখন উপস্থিত হয় তখন তোমার পিতা তার জন্যে দিঘির পাড়ে একটা ঘর বানায়ে দিলেন। মউত ঘর। আমার দাদি শাশুড়ির মৃত্যু মউত ঘরে হয়েছিল। তিনি বড়ই কষ্ট করেছিলেন। তাঁর শরীর পচে গিয়েছিল, চউখ গলে গিয়েছিল। আমি তার সেবা করতাম। শেষের দিকে তার উপর আমি বড়ই নারাজ হয়েছিলাম। আল্লাহপাক তার হিসাব ঠিক রাখবেন। আমারও আমার দাদি শাশুড়ির মতো কষ্টের মৃত্যু হবে। আমার শরীর পচে গেলে যাবে। আমি চাই না তখন কেউ আমার সেবা করুক। তুমি আমার জন্যে মাউত ঘর বানাতে বলো।