সিদ্দিকুর রহমান সাহেবকে আমি পছন্দ করি না। কেন করি না। আমি জানি না। নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। কারণটা আমার কাছে পরিষ্কার না। একটা কারণ হতে পারে মানুষটা ক্ষমতাবান। জমি-জমা, অর্থ-বিত্ত, লোক-লঙ্কর বিরাট রাজত্ব। আর আমি বেতনবিহীন কলেজের হতদরিদ্র ভোঁতা মাস্টার। দস্তয়োভস্কির উপন্যাসের চরিত্র। আমার নুন নাই পান্তাও নাই। তবে নুন পান্তা যে কাঁচামরিচ দিয়ে ডলে খেতে হয় সেই কাঁচামরিচটা আছে।
রেললাইনের উপর বসে আমি প্রায়ই ভাবি–একজন মানুষ যার নাম সিদ্দিকুর রহমান, সে দস্তয়োভস্কির নামও শুনে নাই। কিন্তু সে নিজে দস্তয়োভস্কির এক চরিত্র এবং সে এরকম আরো চরিত্র পুষছে। আমি আনিসুর রহমান সেরকম একটি চরিত্র। ভোঁতা মাস্টার, কুঁজা মাস্টার, গুঁজা মাস্টার। নাম নেই মানুষ। নাম থাকে না পশুদের। তাহলে আমি কি পশু গোত্রের কেউ? কিংবা ক্ৰমে ক্রমে পশু হয়ে যাচ্ছি?
গত সন্ধ্যাবেলায় আমি রেললাইনের উপর বসেছিলাম। হঠাৎ ভূতের মতো পেছন থেকে উদয় হলেন সিদ্দিকুর রহমান। তাঁর সঙ্গে আমার কিছু কথাবার্তা হলো। আমার কথাবার্তা বলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছাও ছিল না। উপায় কী? অতি ক্ষমতাধর সামন্ত প্ৰভু প্রশ্ন করলে তাঁর ক্রীতদাসদের জবাব দিতে হয়। হ্যা আমি ক্রীতদাস। অবশ্যই ক্রীতদাস। তিনবেলা অন্নদান করে তিনি আমাকে কিনে নিয়েছেন। আমি তার অন্নদাস।
সিদ্দিকুর রহমান প্রশ্ন করলেন, সন্ধ্যাবেলা রেললাইনের উপর বসে আছ কেন?
আমি অতি বিনীত ভঙ্গিতে বললাম, স্যার, আপনাকে আরেকদিন বলব।
এই লোক আর চাপাচাপি করল না। চাপাচাপি করলে কিছু একটা বানিয়ে বলে দিতাম। যদিও আমার বলার ইচ্ছা ছিল–আমি রেললাইনে বসে থাকলে তোর কী? রেললাইন তোর তালুকের উপর দিয়ে যায় নাই। সরকারি রেললাইন। ইচ্ছা হলে আমি বসে থাকব। ইচ্ছা হলে শুয়ে ঘুমাব। আমার উপর দিয়ে মালগাড়ি চলে যাবে।
হ্যাঁ, তুই তুই করেই বলতাম। সব মানুষ সমান। মেধায় বুদ্ধিতে একজন বড় একজন ছোট। অথচ আমরা মানুষ বিচার করার সময় তার মেধাবুদ্ধি দেখি না। আমরা দেখি মানুষটার টাকা পয়সা আছে কি-না। উদাহরণ দিয়ে বুঝাই? এই অঞ্চলের জামে মসজিদের ইমাম সাহেবের নাম আব্দুল নুর— নূরের চাকর। এই নূরের চাকরের সঙ্গে গত শনিবার আমার দেখা। আমি উনাকে দেখে মাথা নিচু করে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছি (এটা আমার স্বভাব।— আমি সবসময় চেষ্টা করি। সবাইকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে। বেশির ভাগ সময় সম্ভব হয় না।) উনি বললেন, মাস্টার সাহেব, আসসালামু আলায়কুম।
আমি থমকে দাঁড়িয়ে বললাম, ওয়ালাইকুম সালাম।
উনি গলা তীক্ষ্ণ করে বললেন, একজন মুসলমানের সঙ্গে আরেকজন মুসলমানের যখন দেখা হয় তখন সালাম দিতে হয়। এটা ইসলাম ধর্মের শিক্ষা।
আমি বললাম, জি জি।
উনি বললেন, যে বয়োকনিষ্ঠ সে আগে সালাম দিবে। এটাই ধর্মীয় বিধান। আপনি আমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট। কিন্তু আপনি সালাম দেন না। এর কারণটা কী? জুমার দিন। আপনি জুমার নামাজ আদায় করতে আসেন না, এর কারণ কী?
আমি বললাম, আমি আপনার মতো ভালো মুসলমান না, আমি খারাপ মুসলমান। এইজন্যেই যাই না।
পাঞ্চেগানা নামাজ পড়েন না?
জি-না।
আল্লা-খোদা বিশ্বাস করেন? না-কি তাও করেন না?
আমি জবাব দিলাম না। জবাব দিতে পারতাম। বলতে পারতাম, জি-না আমি আল্লাহ খোদা, ভগবান, জেসাস ক্রাইস্ট, গড কিছুই বিশ্বাস করি না। আমাকে মালেকভাই বলেছিলেন, শুধু নিজেকে বিশ্বাস করবি আর কিছুই বিশ্বাস করবি না। আমি কুঁজা মাস্টার আরো কুঁজা হয়ে গেলাম। মওলানা আব্দুল নূর কঠিন চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর খড়খড়ে গলায় বললেন, চিন্তা করে জবাব দেন।
যে প্রশ্নগুলি এই মওলানা আমাকে করেছেন সেই প্রশ্ন তিনি কিন্তু সিদ্দিকুর রহমান সাহেবকে করবেন না। কারণ সিদ্দিকুর রহমান সাহেবের হিসাব আলাদা। উনি প্রতিবছর গ্রামের একজন মানুষকে নিজ খরচে হজে পাঠান। মওলানা সাহেবকেও একদিন পাঠাবেন। আব্দুল নূর সেই অপেক্ষায় আছেন। মওলানা সাহেবের মাসিক একশত টাকা বেতনও তিনি দেন। সারা বৎসরের খোরাকির চাল দেন।
মওলানা আব্দুল নূর এখনো আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। যেন আমার প্রশ্নের জবাব না। শুনে তিনি যাবেন না। আমি বললাম, মওলানা সাহেব, আপনার বয়স সিদ্দিকুর রহমান সাহেবের চেয়ে অনেক বেশি। ধর্মীয় নিয়মে পথেঘাটে দেখা হলে উনারই উচিত আপনাকে সালাম দেয়া। উনি তা করেন না। আগবাড়িয়ে সবসময় আপনি সালাম দেন। এর কারণ কী? উনি তো প্রায়ই জুম্মার নামাজেও যান না। এই প্রসঙ্গে কি আপনি তাঁকে কিছু বলেছেন?
একটু আগে মওলানা সাহেব আমার জবাবের অপেক্ষা করেছেন। এখন আমি তার জবাবের অপেক্ষা করছি। ফলাফল কেউ কারো প্রশ্নের জবাব দিলাম না। দুজনই মাথা নিচু করে দুদিকে চলে গেলাম।
আমি অভাজন ব্যক্তি। আমার ফটফট করে কথা বলা উচিত না। আমি বলিও না। মুখ বুজে থাকি। মাঝে মাঝে মেজাজ খারাপ হয় তখন বলি। সমস্যা হলো আমার সারাক্ষণই মেজাজ খারাপ থাকে। তখন ইচ্ছা করে আশেপাশে যারা থাকে তাদের সবার মেজাজ খারাপ করে দেই। আমার মেজাজে কারো কিছু যায় আসে না। কেউ খেয়ালও করে না। শুধু সিদ্দিকুর রহমান সাহেবের দুই মেয়ে খেয়াল করে। তারা আমার ভয়ে অস্থির হয়ে থাকে।
দুই মেয়ের একজনের নাম কইতরী, আরেকজন জইতরী। কইতর হলো কবুতর। কবুতর থেকে কইতরী। তাহলে জাইতরীটা কী? জইতর বলে কোনো পাখি কি আছে? যে পাখির নাম থেকে এসেছে জাইতরী? না-কি নামের সঙ্গে মিল রেখে নাম? সিদ্দিকুর রহমান সাহেবকে জিজ্ঞেস করলে তিনি কোনো জবাব দিতে পারবেন না। গ্রামের মানুষদের চিন্তাভাবনা জমি-জমার বাইরে যায় না। তিনি তার বড়মেয়ের নাম রেখেছেন। লীলাবতী। এই নামের অর্থ কি তিনি জানেন? যে লীলা করে বেড়ায় সে-ই লীলাবতী। লীলা অর্থ কেলি, প্রমোদ। অর্থ ঠিকমতো জানলে সিদ্দিকুর রহমান মেয়ের নাম লীলাবতী রাখতেন না।