নৌকা নিয়ে সামনে এগুনো যাচ্ছে না। প্ৰবল বাতাস সামনের দিক থেকে আসছে। বৃষ্টি কমে এসেছে, কিন্তু বাতাসের প্রবল বেগ।
ছাইয়ের দুই মুখ শাড়ির পর্দা দিয়ে ঢাকা। বৃষ্টিতে শাড়ি ভিজে ভারী হয়ে আছে। তারপরেও বাতাসে দুলছে। ছই থেকে একটা হারিকেন ঝুলানো হয়েছে। বাতাসে হারিকেন দুলছে। পরীবানুর গা চাদর দিয়ে ঢাকা। তার ফর্সা রক্তশূন্য মুখ চাঁদরের ভেতর থেকে বের হয়ে আছে। লীলাবতী বসেছে পরীর মাথার কাছে। সে পরীর হাত ধরে আছে। সেই হাত থারথার করে কাঁপছে। পরীবানু। বলল, বুবু, আমার মৃত্যু ঘনাইছে ঠিক না?
লীলা কিছু বলল না। সে একমনে দোয়া ইউনুস পড়ছে— লাইলাহা ইল্লা আনতা সোবাহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজজুয়ালেমিনা। সে দোয়া ঠিকমতো পড়তেও পারছে না। তার কাছে মনে হচ্ছে, কোথাও কোনো গণ্ডগোল হচ্ছে।
বুবু। ও বুবু।
দুইটা সন্তানই কি মারা যাবে? কেউ বাঁচবে না?
শেষরাতে রমিলা খুব হৈচৈ করতে লাগলেন। তিনি তার হাতের টর্চ দিয়ে জানালার শিকে বাড়ি দিচ্ছেন। গোঙানির মতো শব্দ করছেন। সিদ্দিকুর রহমান রমিলার ঘরের জানালার কাছে এসে দাড়ালেন। রমিলা বললেন, আমারে গরম পানি দিতে বলেন, নতুন সাবান দিতে বলেন, নয়া শাড়ি দিতে বলেন। আমি সিনান করব। আল্লাহপাকের দরবারে শুকরানা নামাজ পাঠাব। আপনার পুত্ৰ মাসুদের দুইটা সন্তান হয়েছে। দুইটাই পুত্ৰ সন্তান। তারা ভালো আছে। সন্তানদের মাতাও ভালো আছেন। বলেন, আলহামদুলিল্লাহ।
সিদ্দিকুর রহমান বললেন, আলহামদুলিল্লাহ।
তিনি একবারও জিজ্ঞেস করলেন না, রমিলা, এই সংবাদ কোথায় পেয়েছে? কীভাবে পেয়েছে?
মঞ্জু বিরাট দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়ে গেছে। দুটা পুত্ৰ সন্তান হয়েছে। এখন আযান কি একবার দেয়া হবে, না দুইবার? কেউ তাকে কিছু বলতেও পারছে না। তারা এখনো নৌকায়। হাসপাতালে পৌঁছাতে দেরি আছে। পরীবানুর সন্তান নৌকাতেই হয়েছে এবং ভালোমতোই হয়েছে। তার জ্ঞান আছে। সে জড়ানো গলায় কিছু কথাও বলছে। দুটি বাচ্চাকেই মায়ের বুকে শুইয়ে দেয়া হয়েছে। বাচ্চা দুটির গলায় বিপুল শক্তি। তারা ক্রমাগত চিৎকার করে যাচ্ছে।
মঞ্জুর পাশে সতীশ ডাক্তার বসে আছেন। শেষ মুহুর্তে সন্তান প্রসবের কাজ তিনিই করিয়েছেন। মঞ্জু বলল, ডাক্তার সাহেব, আযান একবার দিব না। দুইবার? কিছু একটা বলেন।
সতীশ ডাক্তার বললেন, আপনাদের ধর্মের বিষয়ে তো আমি কিছু জানি না।
আপনার বিবেচনায় কী বলে?
আমার বিবেচনা বলে দুইবার। সন্তান যখন দুইটা।
মঞ্জু বলল, আমি এই দুই ছেলের নাম রাখলাম। প্ৰথমজনের নাম ঝড়। দ্বিতীয় জনের নাম তুফান। দুই ভাই একত্রে ঝড়-তুফান। হা হা হা।
বদু নৌকার হাল ধরেছিল, সে আনন্দিত গলায় বলল, নাম অতি চমৎকার হয়েছে।
মঞ্জু, আযান দিচ্ছে।
পরীবানু লীলার দিকে তাকিয়ে ক্ষীণ স্বরে বলল, বুবু, আমার নাম দুইটা খুব পছন্দ হইছে— ঝড়-তুফান। বুবু, দুইজনের মধ্যে কে বেশি সুন্দর? ঝড় না তুফান?
লীলা জবাব দিতে পারছে না। সে কেঁদেই যাচ্ছে। তার কান্না থামবে এরকম মনে হচ্ছে না।
কী নাম
কী নাম?
আনিসুর রহমান।
আর কোনো নাম আছে?
জি না।
মালেক বলে কাউকে চেনো?
জি না।
মালেক নাম তো খুবই কমন, এই নামে কাউকে চেনো না?
জি না। কমিউনিষ্ট পাটির নেতা মোহাম্মাদ মালেক। উনাকে চেন না?
জি না।
শরিয়তুল্লাহ বলে কাউকে চেন? ঠিকানা তস্তুরীবাজার।
জি না।
সে তো তোমাকে তিনটা ডিকশনারি পাঠিয়েছিল, তাকে চেনো না?
জি না।
সফিকুর রহমান বলে কাউকে চেনো?
আমার বাবার নাম সফিকুর রহমান।
তাও ভালো, নিজের বাবাকে ইচনতে পারছ। আমি ভেবেছিলাম, তুমি কাউকেই চিনবে না। নিজের বাবাকেও না।
প্রশ্ন কর্তা হেসে ফেললেন। প্রশ্ন কর্তার সঙ্গে যে তিনজন আছেন তারাও হাসলেন। যে ঘরে কথাবার্তা হচ্ছে সেই ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ। ছোট্ট ঘুপচি মতো ঘর। হলুদ রঙের দালান। ছাদ অনেক উঁচু। উঁচু ছাদ থেকে ঝুলন্ত লম্বা তারের মাথায় ইলেকট্রিক বান্ধ। ঘরে কোনো হাওয়া আসছে না। কিন্তু বান্ধটা পেন্ডুলামের মতো দুলছে। আনিসের দৃষ্টি বান্ধে আটকে যাচ্ছে। বাম্বের আলো উজ্জ্বল। মনে হয় একশ পাওয়ারের বাহু। উজ্জ্বল আলো চোখে পড়ায় সে তার সামনে বসা তিনজনকে ঠিকমতো দেখতে পারছে না। যিনি তাঁকে প্রশ্ন করছেন তিনি পুলিশের কোনো সিনিয়র অফিসার হবেন। কারণ তাঁর পাশের দুজন অত্যন্ত সমীহ করে তাঁর দিকে তাকাচ্ছেন। মূল প্রশ্নকর্তার গায়ে সার্ট-প্যান্ট। সাটের রঙ হালকা নীল। বাকি দুজনের গায়ে পুলিশের পোশাক। প্রশ্ন কর্তার সামনের টেবিলে ফুলতোলা একা রুমাল। রুমালে একটা পিস্তল।
তোমার নাম আনিসুর রহমান?
জি।
তোমার বাবা নাম সফিকুর রহমান?
জি।
এমএ পাশ করেছ?
জি।
তোমার বিষয়বস্তু হলো ইতিহাস।
জি।
টেবিলে রাখা পিস্তলটা তুমি চেনো? চেনো না? তোমাকে চিনতেই হবে, কারণ তোমাকে ধরা হয়েছে পিস্তলসহ। এখন বলো, পিস্তলটিা চেনো না?
জি চিনি।
এই পিস্তল কখনো ব্যবহার করেছ?
জি না।
ব্যবহার করো নাই কী জন্যে?
আমাকে পিস্তলটা লুকিয়ে রাখার জন্যে দেয়া হয়েছে। ব্যবহার করার জন্য দেয়া হয় নি।
কে তোমাকে দিয়েছে?
আমি তার নাম বলব না।
নাম তো অবশ্যই বলবে। আমরা এখনো জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করি নাই। যখন জিজ্ঞাসাবাদ সত্যি সত্যি শুরু করব, তখন প্রশ্ন জিজ্ঞাস করার আগেই উত্তর দিয়ে দিবে। তোমাকে তোমার নাম জিজ্ঞসা করব, তুমি নিজের নাম তো বলবেই, তোমার বাবার নাম বলবে, তোমার শ্বশুরের নামও বলবে। শ্বশুরের নাম কী?