এই বলেই সে আমার দিক থেকে আঙুল সরিয়ে নদীর পাড়ের একটা অংশ আঙুল দিয়ে দেখাল। যেভাবে সে পানি থেকে আস্তে আস্তে উঠেছিল সেইভাবেই আস্তে আস্তে পানিতে ড়ুবে গেল। সারাক্ষণই আঙুল নদীর পাড়ের দিকে ধরে থাকল। আমি অজ্ঞান হয়ে পাটিতে পড়ে গেলাম। বেহারারা অজ্ঞান অবস্থাতেই আমাকে বাড়িতে নিয়ে গেল। আমার জ্ঞান ফিরে চার ঘণ্টা পরে। তখন আমার সারা শরীর দিয়ে বিজল বের হচ্ছে। বিজল চিন? বিজল হলো তৈলাক্ত জিনিস।
বাবা থামলেন। এখন তিনি আর আমার দিকে তাকাচ্ছেন না। তিনি আবারো মুখ ঘুরে বসেছেন। আমার সঙ্গে কথাবার্তা শেষ হয়েছে এরকম ভাব। আমি বললাম, আপনি তখন খুব অসুস্থ ছিলেন। শীতল পাটিতে শুয়ে থাকলেন। উঠে বসার মতো সামর্থ্যও ছিল না। আমার ধারণা। আপনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখেছেন। স্বপ্নটা আপনার কাছে সত্যি মনে হয়েছে। মাঝে মাঝে অনেক স্বপ্ন আমাদের কাছে সত্যি মনে হয়।
বাবা বললেন, তোমার কথার মধ্যে যুক্তি আছে। যুক্তির কথা আমার পছন্দ।
আমি বললাম, অন্ধ মানুষটা আপনাকে যে জায়গাটা দেখিয়েছিল সেই জায়গাটার কি আপনি খোঁজ করেছিলেন?
বাবা শান্ত গলায় বললেন, হ্যাঁ। পরের দিনই সেখানে গিয়েছি।
কিছু পান নাই?
বাবা শান্ত গলায় বললেন, খুঁড়াখুড়ি করি নাই।
কেন করেন নাই? আপনার কৌতূহল হয় নাই?
কৌতূহল হয়েছে, কিন্তু ভূত-প্রেতের কাছ থেকে কিছু নিতে ইচ্ছা করে নাই। তবে সেই জায়গা আমি পরে কিনে নিয়েছি। আমি মাঝে মাঝেই সন্ধ্যার দিকে ঐ জায়গায় বসে থাকি।
অন্ধ লোকটার দেখা পাওয়ার জন্যে?
হ্যাঁ, তবে তাকে লোক বলবে না। সে মানুষ না, অন্য কিছু।
আবার তার দেখা পেতে চান কেন?
আমি তাকে জিজ্ঞেস করব, সে কে?
সে কে এটা জেনে আপনার লাভ কী?
কোনো লাভ নাই। কৌতূহল মিটানো। মানুষ কৌতূহল মিটানোর জন্যে অনেক কিছু করে। শুধু যে মানুষ করে তা-না। পশুপাখি কীটপতঙ্গ সবাই কৌতূহল মিটাতে চায়। তুমি যদি সন্ধ্যাবেলায় একটা কুপি জ্বালাও, দেখবে অনেক পোকা আগুনে এসে পড়ে। তাদের কৌতূহল হয় আগুন জিনিসটা কী জানার। জানতে এসে মারা পড়ে।
আপনি আমাকে একদিন আপনার সঙ্গে নিয়ে যাবেন? জায়গাটা দেখব।
অবশ্যই নিয়ে যাব। কবে যাবে বলো। কাল যেতে চাও?
হ্যাঁ যাব।
আমি এখন আমার বাবার প্রসঙ্গে কিছু কথা বলি। তিনি শুরুতে আমার কাছে ছিলেন অতি দুষ্ট্র একজন মানুষ। যে তাঁর স্ত্রী-কন্যাকে দূরে ঠেলে দেয়— আরেকটি বিবাহ করে। সুখে যে ঘর-সংসার করে তা-না। স্ত্রীকে তালা আটকে বন্দি করে রাখে। তাঁর সঙ্গে পরিচয় হবার পর মনে হলো— ভয়াবহ দুষ্ট্র মানুষদের একজন সম্ভবত তিনি না। ক্ষমতাধর মানুষদের দুর্বলতা তার মধ্যে আছে। বদরাগ, অহঙ্কার–এইসব বিষয় তাঁর কাছে চরিত্রের অহঙ্কার। দুর্বলতা না।
এখন মনে হচ্ছে মানুষটা ভাবুক প্রকৃতির। শুধু যে ভাবুক তা-না। তার মধ্যে চিন্তা করার দুর্লভ ক্ষমতা আছে। মানুষটির ভালোবাসার ক্ষমতাও প্রবল। তার ভালোবাসা আড়াল করার চেষ্টাটাও চোখে পড়ার মতো— আমি ভালোবাসব কিন্তু কেউ যেন তা বুঝতে না পারে।
এই মানুষটির মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণ রহস্যময়তাও আছে। তাঁর মাথায় ঘুরছে। আশ্রম। সেই আশ্রমও তার কল্পনার আশ্রম। বিশাল একটা এলাকা থাকবে। সেই এলাকায় পশুপাখি নিজের মতো করে ঘুরবে কিন্তু কোনো মানুষ থাকবে না। মানুষ বলতে তিনি একা থাকবেন।
বাবা তার আশ্রম তৈরি করা শুরু করেছেন। আমি একদিন দেখে এসেছি। দুনিয়ার পাখি সেখানে। পাখি কেনইবা আসবে না? তাদেরকে ধান, কুড়া, সরিষাদানা আর কী কী যেন খেতে দেয়া হয়। অনেক গাছে দেখলাম মাটির কলসি উল্টা করে বাধা। যে সব পাখি বাসা বাধতে জানে না। তাদের জন্যেই এই ব্যবস্থা।
এই বিষয়টিকে কি আমি পাগলামি বলব? কিছু পাগলামি সব মানুষের মধ্যেই আছে। তবে বেশির ভাগ মানুষ এইসব পাগলামি প্রশ্ৰয় দেয় না। বাবা দেন। পাগলামি প্রশ্ৰয় দেয়ার ক্ষমতা আছে বলেই হয়তো দেন।
বাবার প্রসঙ্গে একটা অদ্ভুত গল্প এখন বলব। এই গল্পে আমার বিশেষ একটা ভূমিকা আছে। ঘটনাটা আমি কাছ থেকে দেখেছি।
নান্দিপুর থেকে একবার বাবার কাছে এক লোক এলো তার ছেলেকে নিয়ে। নান্দিপুর আমাদের এখান থেকে প্রায় ছয় ক্রোশ অর্থাৎ বার মাইল দূর। ছেলেটার বয়স দশ-এগারো। খুবই অসুস্থ। কয়েক বছর ধরে না-কি সে কিছুই খেতে পারে না। হজম হয় না। অতি সহজপাচ্য ভাতের মাড়, চিড়ার ক্যাথ এইসব তাকে খাওয়ানো হয়। এটাও সে হজম করতে পারে না। ছেলেটা রোগা কাঠি। দেখে মনে হয় পাঁচ-ছয় বছর বয়স। তার বাবা এই দীর্ঘ পথ তাকে ঘাড়ে করে এনেছে। ছেলের হাঁটারও ক্ষমতা নেই।
বাবা বললেন, আমার কাছে আসছ কী জন্যে? চিকিৎসার খরচা চাও?
ছেলের বাবা বলল, না। চিকিৎসার খরচার জন্যে আপনার কাছে আসি নাই। আপনি তারে একটু উতার (পানি পড়া) দেন।
আমি তারে উত্তর দিব? আমি কি পীর-ফকির?
আপনের দেওয়া উতার খাইলে তার রোগ সারব।
তোমাকে কে বলেছে?
লোকটা জবাব দিল না। মাথা গোজ করে ছেলের হাত ধরে দাঁড়িয়ে রইল। বাবা লোকমান চাচাকে বললেন, এদেরকে যেন বাড়ির সীমানা থেকে বের করে দেয়া হয়।
তাই করা হলো। লোকটা কিন্তু গেল না। বাড়ির সীমানার বাইরে একটা আমগাছের নিচে ছেলেকে নিয়ে বসে রইল। শীতের রাত। তারা কাপড়চোপড় নিয়ে আসে নি। লোকটা শুকনো লতাপাতা জোগাড় করে আগুন ধরাল। আগুনের পাশে ছেলেকে নিয়ে জবুথবু হয়ে বসে রইল। অদ্ভুত এক দৃশ্য! রাত দশটার দিকে আমি বাবাকে গিয়ে বললাম, পানি পড়া চাচ্ছে, দিয়ে দেন। ছেলেকে নিয়ে চলে যাক।