আমি বললাম, চল ফেরত যাই। পরীবানু বলল, আপনি বাড়িতে চলে যান। আমি যাব না। আমি তার কাছে যাব। এই দেখেন আপনার ভাই হাত ইশারায় ডাকতেছে।
পরীবানুর গলার স্বর গম্ভীর। সে যে কবরের কাছে যাবে তা তার গলার স্বরেই বোঝা যাচ্ছে। শেষপর্যন্ত দুজনে মিলেই গেলাম। কবরের কাছাকাছি যাবার আগেই ছায়ামূর্তি মিলিয়ে গেল।
সেই রাতেই এই ঘটনা বাবার কানে পৌছল। তিনি আমাকে ডেকে পাঠালেন। বাবা খাটে পা তুলে বসেছিলেন। তার সামনে হুক্কা। তিনি নল হাতে বসে আছেন। হুক্কা টানছেন না। আমি তার সামনে দাঁড়াতেই তিনি ইশারা করলেন বসতে। আমি তার পাশে বসলাম। বাবা আমার দিকে না তাকিয়েই বললেন– এইটা কি মাস জানো?
আমি বললাম, আশ্বিন মাস।
বাবা বললেন, আশ্বিন মাসে চাঁদের দশ তারিখ থেকে বিশ তারিখ গ্রামের মানুষ ভূত-প্ৰেত বেশি দেখে, এইটা জানো?
আমি বললাম, জানি না।
পাতার ফাঁকে এই জোছনা যখন আসে তখন মনে হয়। ভূত-প্ৰেত।
আমি বাবার কথা বুঝতে পারছিলাম না। তিনি প্রস্তাবনা শুরু করেছেন। মূল বক্তব্যে এক্ষুনি যাবেন, তার জন্যে অপেক্ষা করাই ভালো।
লীলা শোনো। জামগাছের পাতার ফাঁক দিয়ে আশ্বিন মাসের ১৩ তারিখে জোছনা নেমেছে। সেই জোছনায় ছায়া তৈরি হয়েছে। ছায়াটা পড়েছে কবরে। তোমরা সেই ছায়াটাকে মনে করেছ মাসুদ। মৃত মানুষ ফিরে আসে না। কায়া ধরেও আসে না, ছায়া ধরেও আসে না।
বাবার যুক্তি আমি সঙ্গে সঙ্গে মানলাম। এত পরিষ্কার চিন্তা গ্রামের মানুষ সাধারণত করে না। কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তা করার অভ্যাস না থাকলে চিন্তার মতো পরিশ্রমের কাজ গ্রামের মানুষজন করে না। এই মানুষটা করেন। ভালোমতোই করেন।
লীলা।
জি।
যদি একজন কেউ ভূত দেখে ফেলে তখন অন্যরাও দেখা শুরু করে। ভূত দেখা কলেরা রোগের মতো। একজনের হলে তার আশেপাশে দশজনের হয়। কাজেই তোমরা ভূত দেখাদেখি নিয়ে আলোচনা করবে না।
জি আচ্ছা।
কাল সকালে আমি জামগাছ দুটা কাটায়ে ফেলব। কবরের আশেপাশে গাছ থাকার প্রয়োজন নাই।
মনে হয় তার কথা বলা শেষ হয়েছে। তিনি তামাক টানা শুরু করেছেন। আমি চলে যাবার জন্যে উঠে দাঁড়ালাম না, বসেই রইলাম। অতি নিঃসঙ্গ এই মানুষটার জন্যে মায়া লাগছে। তাঁর সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলতে ইচ্ছে করছে। এত বড় ঘটনা ঘটে যাবার পরেও মানুষটার মানসিক শক্তি আমি মুগ্ধ হয়ে দেখছি। বড় ধরনের ধাক্কা তিনি খেয়েছেন। তার ছাপ আমি দেখতে পাচ্ছি। তিনি আগের মতো হেঁটে জঙ্গলা ভিটায় যেতে পারেন না। তাকে এখন লোকমান-সুলেমানের কাধে ভর দিয়ে যেতে হয়।
লীলা, তুমি কিছু বলতে চাও?
আমি বললাম, আপনি ভূত-প্ৰেত বিশ্বাস করেন না?
বাবা তামাক টানা বন্ধ করে আমার দিকে ফিরলেন।
আগে আমরা পাশাপাশি বসেছিলাম, এখন বসেছি মুখোমুখি।
বাবা বললেন, মানুষ মরে ভূতপ্রেত হয়। এইসব বিশ্বাস করি না, তবে অন্য কিছু আছে।
অন্য কিছুটা কী?
ভূত-প্ৰেত জগতের জিনিস। আমি একবার দেখা পেয়েছিলাম। তুমি কি ঘটনাটা শুনতে চাও?
শুনতে চাই।
তোমার মাকে বিবাহের রাতেই ঘটনাটা বলেছিলাম। সে অত্যধিক ভয় পেয়েছিল।
আমি সহজে ভয় পাই না।
বাবা ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তুমি আমার মতো হয়েছ। আমার মধ্যে ভয়-ডর কম। সব মানুষের মৃত্যুভয় থাকে। আমার সেই ভয়ও নাই। মৃত্যু যখন হবার হবে। তার ভয়ে অস্থির হবার কিছু নাই।
আপনি ঘটনাটা বলেন।
আমার যৌবনকালের ঘটনা। বয়স কুড়ি-একুশ। তারচেয়ে কিছু কমও হতে পারে। তখন হলো টাইফয়েড। বাংলায় বলে সান্নিপাতিক জুর। তখন টাইফয়েড রোগের কোনো চিকিৎসা ছিল না। এই রোগ হওয়া মানেই মৃত্যু। আমার মৃত্যু হলো না, একত্রিশ দিনের মাথায় জ্বর ছাড়ল। শরীর অতি দুর্বল। দুই পা হাঁটলে মাথা ঘুরে। কিছু খেতে পারি না। হজম হয় না। দুইবেলা জাউ ভাত আর শিং মাছের ঝোল খাই। আমার দাদি তখন আমার স্বাস্থ্যু ঠিক করার দায়িত্ব নিলেন। তিনি হুকুম দিলেন, প্রতিদিন যেন আমাকে নদীর পাড়ে হাওয়া খেতে নিয়ে যাওয়া হয়। নদীর টাটকা হাওয়া রুচিবর্ধক। চারজন বেহাৱা পালকিতে করে আমাকে নদীর পাড়ে নিয়ে যায়। সেখানে পাটি পেতে দিয়ে দূরে গিয়ে গাজা ভাং খায়। সন্ধ্যা মিলাবার পর আমাকে নিয়ে ফিরে আসে। আমি নদীর দিকে তাকিয়ে শীতল পাটিতে শুয়ে থাকি।
জায়গাটা অতি নির্জন। আশেপাশে কোনো লোকবসতি নাই। নদীর ঐ পাশে ঘন বন। দিনের বেলায়ও শিয়াল ডাকে।
একদিনের ঘটনা। সন্ধ্যা হয়েছে। দিনের আলো সামান্য আছে। আমি শুয়ে আছি। বেহাৱা চারজন দূরে কোথাও গেছে। গাজ-টাজা খাচ্ছে হয়তো। আমার দৃষ্টি নদীর পানির দিকে। হঠাৎ দেখি পানিতে ঘূর্ণির মতো উঠেছে। এটা এমন কোনো বিশেষ ঘটনা না। নদীর পানিতে প্রায়ই ঘূর্ণি ওঠে।
হঠাৎ আমার গা ঝাড়া দিয়ে উঠল। আমি শোয়া থেকে উঠে বসলাম। দেখি নদীর ঘূর্ণি থেকে কে যেন মাথা ভাসায়ে দিয়েছে। প্রথমে চুল দেখলাম, তারপর মাথা। সেই মাথা পুরাপুরি মানুষের মাথা না। চোখ নাই। যাদের চোখ থাকে না তাদের চোখে কোটর থাকে। এর তাও নাই। চোখের জায়গায় মুখের চামড়ার মতো চামড়া। বাকি সব ঠিক আছে। নাক আছে, মুখ আছে, কান আছে। জিনিসটা বুক পর্যন্ত পানির উপর উঠল। তারপর কথা বলল। আমার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল— এই, মন দিয়ে শোন। পিতলের একটা ঘড়া মাটিতে পোতা আছে। তোকে দিলাম। তুই ভোগদখল কর। ঘড়াটা কই আছে নজর করে দেখ। তাকা আমার আঙুলের দিকে।