আমার কোনো ভাই নেই। একটা ভাই ছিল। সে মারা গেছে। এখনো কি আমি ভাগ্যবতী? মানুষ আলাদা আলাদা ভাগ্য নিয়ে আসে না। একজনের ভাগ্যের সঙ্গে আরেকজনের ভাগ্য জড়ানো থাকে। একজনের ভাগ্যে ধ্বস নামলে, পাশের জনের ভাগ্যেও লাগে। আচ্ছা, এইসব আমি কী লিখছি? আর কেনইবা লিখছি? কে পড়বে আমার এই লেখা!
কেউ না পড়ুক, আমি আমার ভাইয়ের বিষয়টা গুছিয়ে লিখতে চাই। আমার মন বলছে, খুব গুছিয়ে বিষয়টা লিখলেই আমার মন অনেক হালকা হয়ে যাবে। কিন্তু লিখবটা কী? আমি তো তাকে সেইভাবে জানি না। তার জানাজা পড়ানো হলো শহরবাড়ির সামনের মাঠে। জানাজায় মেয়েরা অংশ নিতে পারে না। জানাজার পুরো ব্যাপারটা আমি দেখলাম জানোলা দিয়ে। আমার পাশে পরীবানু ও দাঁড়িয়ে ছিল। একবার ভাবলাম তাকে বলি, তোমার দেখার দরকার নেই। তোমার মন খারাপ হবে। তারপরই মনে হলো, সে যে অবস্থায় আছে তারচে খারাপ হবার তো কিছু নেই।
তবে পরীবানু শক্ত মেয়ে। সে কাদছিল, কিন্তু চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলছিল না। জানাজা প্রক্রিয়াটি সে দেখছিল যথেষ্ট আগ্রহ নিয়ে।
একটা নকশাদার খাটিয়ায় সাদা কাপড়ে মোড়ানো কফিন। তিনটা হ্যাজাক লাইট জ্বালানো হয়েছে। এর মধ্যে একটা নষ্ট। কিছুক্ষণ পর পর হ্যাজাকের সাদা আলো লাল হয়ে যাচ্ছে। খাটিয়ার চার মাথায় আগরবাতি জ্বলছে। আগরবাতির আলো জোনাকির মতো জ্বলছে নিভছে। বাতাস ছিল না বলে আগরবাতির ধোয়া সোজা উপরের দিকে উঠছে। চারদিকের গাঢ় অন্ধকারে সাদা ধোয়ার সুতা আকাশে মিশে যাচ্ছে, দেখতে খুবই সুন্দর লাগছে।
সারি বেঁধে সবাই দাঁড়িয়েছে। নামাজ শুরু হবার আগে বাবা বললেন, জানাজার নামাজের আগে মৃত ব্যক্তির সৎগুণ নিয়ে আলোচনা নবীর সুন্নত। নবীজি এই কাজটি করতেন। আপনারা আমার ছেলে সম্পর্কে ভালো কিছু যদি জানেন তাহলে কি একটু বলবেন?
সারি বেঁধে দাঁড়ানো লোকজন একে অন্যের দিকে তাকাচ্ছে। গুনগুন শব্দও হচ্ছে। কেউ এগিয়ে আসছে না। বাবা বললেন, মিথ্যা করে কিছু বলবেন না। অনেক সময় মৃত ব্যক্তির প্রতি সম্মান দেখানোর জন্যে মিথ্যা মিথ্যা ভালো ভালো কথা বলা হয়। দয়া করে কেউ মিথ্যাচার করবেন না।
কেউ এগিয়ে আসছে না। আমার খুবই রাগ লাগছে। আমি গুনে দেখেছি সর্বমোট একশ ষোলজন মানুষ আছে জানাজায়। এতজন মানুষের কেউ আমার ভাই সম্পর্কে একটা ভালো কথা বলবে না? কোনো সৎগুণই কি তার নাই? পরীবানু আমার কাঁধে হাত রেখেছে। সেই হাত থরথর করে কাঁপছে। পরীবানু। ভাঙা গলায় বলল, বুবু, কেউ কিছুই বলতেছে না কেন? কেন কেউ কিছু বলে না?
পরীবানুর ভাঙা গলা, তার শরীরের কাঁপুনি, আমার রাগ এবং দুঃখবোধ সব মিলিয়ে কিছু একটা হয়ে গেল— আমি জানালার পর্দা সরিয়ে উঁচু গলায় বললাম, আমি কিছু বলব। আমার গলার স্বর মনে হয় যথেষ্টই উঁচু ছিল। সবাই জানালার দিকে তাকাল। মওলানা সাহেবের ভুরু যে কুঁচকে উঠেছে তা আমি না দেখেও বুঝতে পারছিলাম। তিনি ফিসফিস করে বাবাকে কী যেন বললেন। খুব সম্ভবত তিনি বললেন– এইসব বিষয়ে মেয়েরা কিছু বলতে পারবে না। তারা থাকবে পর্দায়। মওলানা সাহেবের কথা না শোনা গেলেও বাবার কথা শোনা গেল। বাবা বললেন, মেয়েদের যদি কিছু বলার থাকে তারাও বলতে পারে। আমি তাতে কোনো দোষ দেখি না। মা তুমি বলো। পর্দার আড়াল থেকে বলো।
আমি কী বলব বুঝতে পারছি না। আমি তো মাসুদের বিষয়ে কিছুই জানি না। আমি তাকালাম পরীবানুর দিকে। পরীবানু বলল, বুবু বলেন— সে জীবনে কোনোদিন কোনো মিথ্যা কথা বলে নাই।
আমি নিচুগলায় পরীকে বললাম, কথাটা বোধহয় ঠিক না। তুমি ভেবে বলো, যেটা সত্যি সেটা বলো।
পরীবানু বলল, বুবু, আপনাকে ভুল বলেছি, সে মিথ্যা কথা বলতো। তার মতো নরম দিলের মানুষ তিন ভুবনে ছিল না, কোনোদিন হবেও না। আপনি এই কথাটা বলেন।
আমি বললাম, আমার ভাই ছিল অতি হৃদয়বান একজন মানুষ।
পরীবানু বলল, তার বিষয়ে আরো অনেক কিছু বলার আছে বুবু, এখন মনে আসতেছে না।
আমি বললাম, থাক আর দরকার নাই।
মাসুদের কবর হলো বাড়ির পেছনে জামগাছের তলায়। পাশাপাশি দুটা জামগাছ— একটা বড়, একটা ছোট। গাছতলায় কবর দেয়ার কারণ হলো— গাছপালা সবসময় আল্লাহর জিকির করে। সেই জিকিরের সোয়াব কবরবাসী পায়।
স্বামীর কবরের কাছে যাওয়া পরীবানুর জন্যে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো। সন্তানসম্ভবা স্ত্রীরা না-কি স্বামীর কবরের কাছে যেতে পারে না। এতে পেটের সন্তানের বিরাট ক্ষতি হয়।
আমি পরিবানুকে বললাম, তোমার যখন ইচ্ছা হবে তুমি কবরের কাছে যাবে। এত নিষেধ মানার কিছু নাই। তবে রাতে যদি কখনো যেতে ইচ্ছা করে একা যাবে না। আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবে।
পরী বানু বলল, একা যাব না কেন?
আমি বললাম, ভয় পেতে পারো।
পরীবানু বলল, ভয় পাব কেন? যে জীবিত অবস্থায় আমাকে ভালোবেসেছে। সে মৃত অবস্থায় আমাকে কেন ভয় দেখাবে?
আমি বললাম, তোমার যদি একা যেতে ইচ্ছা করে তুমি একা যেও। অসুবিধা নেই।
পরীবানু প্রতি রাতেই মাসুদের কবরের কাছে যেত। বেশির ভাগ সময় আমি থাকতাম সঙ্গে। এক রাতে একটা ঘটনা ঘটল। শহরবাড়ি থেকে কবরে যেতে হলে বাঁশঝাড়ের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। বাঁশঝাড়ে ঢুকেছি। সেখান থেকে হঠাৎ কবরের দিকে চোখ গেল। দেখি একটা ছায়ামূর্তি কবরে হাঁটাহাঁটি করছে। ছায়ামূর্তি দেখতে অবিকল মাসুদের মতো। মাসুদ যেমন মাথা ঢেকে চাদর পরত ছায়ামূর্তির গায়ে সেরকম চাদর। আমি থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম। পরীবানু অস্ফুট শব্দ করে আমার হাত ধরে ফেলল। তারপরই চাপা গলায় বলল, বুবু, কিছু দেখেছেন?