রমিলা জবাব দিলেন না। বড় করে নিঃশ্বাস ফেললেন। সিদ্দিকুর রহমান বললেন, আমি লোকমানকে পাঠাচ্ছি। সে তোমার ঘরের দরজা খুলে দিবে।
আপনার মেহেরবানি।
মাসুদের মৃত্যুসংবাদ তোমাকে কে দিয়েছে এটা আমাকে বলতে চাচ্ছি না কেন?
বললে আপনি বিশ্বাস করবেন না। কেউ আমাকে বিশ্বাস না করলে আমার খারাপ লাগে।
সিদ্দিকুর রহমান বললেন, অবিশ্বাস করার তো কিছু নাই। তুমি শুধু শুধু মিথ্যা কথা কেন বলবো?
রমিলা চাপা গলায় বললেন, মাসুদের মৃত্যুসংবাদ আমাকে সে নিজেই দিয়েছে। আমার ঘরে সে এসেছিল। আমার বিছানায় অনেকক্ষণ বসেছিল। বারান্দায় যখন হারিকেন জ্বালাল তখন চলে গেল। আপনি কি আমার কথা বিশ্বাস করেছেন?
সিদ্দিকুর রহমান জবাব দিলেন না। রমিলা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, এইজন্যেই তার নামটা আপনারে বলি নাই।
সিদ্দিকুর রহমান দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বদ্ধ উন্মাদের প্রলাপ। স্বাভাবিক আচরণের মাঝখানে ভয়ঙ্কর অস্বাভাবিকতা। তালা খুলে এই উন্মাদকে ছেড়ে দেয়া ঠিক হবে না। যে-কোনো মুহুর্তে সে ভয়ঙ্কর কিছু করে ফেলবে। তিনি পরীবানুর ঘরের দিকে রওনা হলেন। আশ্চর্য কাণ্ড, পা টেনে এগোতে তার কষ্ট হচ্ছে। শরীর ভারী হয়ে গেছে। পা ক্লান্ত। শরীরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গই কি আলাদা করে বিশ্রাম চায়? চোখ ক্লান্ত হলে চোখের পাতা নেমে আসে। পা ক্লান্ত হলে হাঁটার মাঝখানে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে। তারও কি এরকম হবে? পরীবানুর ঘরের কাছে এসে পা থেমে যাবে?
পরী ঠিক আগের জায়গাতেই আছে। লীলা পরীর পাশে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। মনে হচ্ছে সে গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। পরীর একটা হাত লীলার কপালে। শ্বশুরকে দেখে পরী লীলার কপাল থেকে হাত তুলে নিল। শ্বশুরের দিকে তাকাল।
সিদ্দিকুর রহমান বললেন–মা, তোমার কাছে আমি ক্ষমা চাইতে এসেছি। আমার ছেলে যে এমন কাণ্ড করবে। আমি বুঝতে পারি নাই।
পরী জবাব দিল না। শ্বশুরের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। তার দৃষ্টিতে রাগ, অভিমান, দুঃখ কিছুই নেই। আবেগহীন, ভাষাহীন বড় বড় চোখ।
সিদ্দিকুর রহমান পরীর কাছে এগিয়ে গেলেন। তার মাথায় হাত রাখলেন। পরী সামান্য কেঁপে উঠল। সিদ্দিকুর রহমান বললেন, এত বড় দুর্ঘটনা আমার কারণে ঘটেছে। তার জন্যে তুমি যদি আমাকে কোনো শাস্তি দিতে চাও দিতে পারে।
সিদ্দিকুর রহমান পরীর মাথায় হাত বুলাচ্ছেন। পরীর সারা শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। একসময় তার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে শুরু করল।
রাত এগারোটা।
বড়বাড়ির পেছনের বাগানে মাসুদের জন্যে কবর খোড়া হয়েছে। লাশ ধোয়ানো হয়েছে। কাফন পরিয়ে রাখা হয়েছে। জানাজা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে লাশ কবরে নামানো হবে। মধ্যরাতের আগেই লাশ কবরে নামাতে হয়।
সিদ্দিকুর রহমানকে মধ্যরাতে জানানো হলো, ইমাম সাহেব জানাজা পড়তে কিছুতেই রাজি না। তবে তিনি খাস দিলে দোয়াখায়ের করবেন। সিদ্দিকুর রহমান বললেন, ঠিক আছে। আল্লাহপাক মাসুদের কপালে যা রেখেছেন তা-ই হবে। লাশ কবরে নামানোর ব্যবস্থা করো। তবে মাটি দিও না। লাশ কবরে নামানোর পর ইমাম সাহেবকে খবর দিয়ে আনবে, তিনি যেন দোয়া করেন। তার দোয়ার পরে মাটি দেয়া হবে।
ইমাম সাহেব সঙ্গে সঙ্গেই এলেন। তিনি কিছুটা সংকুচিত। সেই সঙ্গে ভেতরে ভেতরে আনন্দিত। অতি ক্ষমতাবান, একজনের হুকুম তিনি অগ্রাহ্য করতে পেরেছেন। এমন যুক্তিতে করেছেন যে ক্ষমতাবান মানুষটার বলার কিছু নাই। এই অঞ্চলে তাকেও লোকজন ক্ষমতাধর মানুষ হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করবে।
ইমাম সাহেবের নাম আব্দুল নূর। ফরিদপুরের মানুষ। এই অঞ্চলে স্থায়ী হয়ে গেছেন। ঘর-বাড়ি করেছেন। স্ত্রীকে নিয়ে বাস করেন। তার বাড়ির নাম হয়েছে ইমামবাড়ি। ইমাম সাহেবের জিন-সাধনা আছে এমন জনশ্রুতি। এই বিষয়ে কেউ কিছু জানতে চাইলে তিনি মধুর ভঙ্গিতে হাসেন। হ্যাঁ-না কিছুই বলেন না।
আব্দুল নূর উঠানে সিদ্দিকুর রহমানের সঙ্গে দেখা করতে এসে অতি বিনয়ী গলায় বললেন, জনাব, আপনি আমার উপর বিরাগ হবেন না। অপঘাতে মৃতের জানাজা হবার নিয়ম নাই। ইসলামি কানুনের বরখেলাপ হয় এমন কিছুই আমি করব না। যদি করি তাহলে আল্লাহপাক নারাজ হবেন। মানুষের নারাজি আমি নিতে পারব, আল্লাহপাকের নারাজি নিতে পারব না।
সিদ্দিকুর রহমান বললেন, আপনার নিজের যদি অপঘাতে মৃত্যু হয় তাহলে তো আপনারও জানাজা হবে না। ঠিক না?
জি ঠিক।
সিদ্দিকুর রহমান শান্ত গলায় বললেন, আমার ছেলের যদি জানাজা না হয় তাহলে আপনারও যেন জানাজা না হয়— সেই ব্যবস্থা আমি নিতে পারি, তা কি আপনি জানেন?
আব্দুল নূর চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলেন।
সিদ্দিকুর রহমান বললেন, আমি যে মানুষ খারাপ এটা সবাই জানে। আপনি বিদেশী লোক বলে আপনি জানেন না। আমার ছেলের জন্যে দোয়া করবেন। এইজন্যে আপনারে আমি ডাকি নাই। এই কথাগুলি বলার জন্যে ডেকেছি। এখন আপনি যান।
আব্দুল নূর বিড়বিড় করে বললেন, জনাব, আমি জানাজা পড়াব।
সিদ্দিকুর রহমান বললেন, খুবই ভালো কথা, লাশ কবরে নামানো হয়ে গেছে, লাশ কবর থেকে তুলে জানাজার ব্যবস্থা করেন। একবার লাশ কবরে নামানোর পর সেই লাশ আবার তোলার বিষয়ে কি কোনো বিধি-নিষেধ আছে?
জি-না।
এখন আমার সামনে থেকে যান।
জি আচ্ছা।
আব্দুল নূর মাথা নিচু করে বের হয়ে গেলেন। আব্দুল নূর এবং সিদ্দিকুর রহমান দু’জনের কেউই টের পেলেন না। এই নাটকীয় কথোপকথন বারান্দা থেকে শুনল পরীবানু। সিদ্দিকুর রহমান নামের মানুটার উপর থেকে হঠাৎ তার সব রাগ দূর হয়ে গেল।
আমি কন্যা লীলাবতী
আমি কন্যা লীলাবতী, ভাইয়ের বোন ভাগ্যবতী।