দুই ভাই একসঙ্গে জবাব দিল— জি চাচাজি?
সিদ্দিকুর রহমান শান্ত গলায় বললেন, বাড়িতে একটা মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু বাড়িতে কোনো কান্নার শব্দ নাই। এটা কেমন কথা?
লোকমান এবং সুলেমান নড়েচড়ে বসল। কেউ জবাব দিল না। তারা খুব ভালো করে জানে সিদ্দিকুর রহমান তার বেশিরভাগ প্রশ্নেরই জবাব শুনতে চান না।
জন্ম এবং মৃত্যু এই দুই সময়েই শব্দ করে কাঁদতে হয়। জন্মের সময় দুজন কাদে। যার জন্ম হয় সে কাব্দে। আর কাদে তার মা। মৃত্যুর সময় অনেকেই কাব্দে। শুধু যে মারা গেল সে কাঁদতে পারে না। সুলেমান!
জি চাচাজি?
থানায় কি লোক গিয়েছে?
জি, ওসি সাহেব আসতেছেন।
জানাজার ব্যাপারে কোনো মীমাংসা হয়েছে?
জি-না। মওলানা সাহেব বলেছেন, অপঘাতে মৃত্যু, জনাজা হবে না। কিতাবে লেখা আছে।
তুমি মাওলানা সাহেবকে বলে আসো— অপঘাতে মৃত্যু হলে জানাজা হবে। না এটা কোন কিতাবে লেখা আছে আমাকে যেন এনে দেখায়।
এখন যাব?
হ্যাঁ, এখন যাবে।
সুলেমান চলে গেল। লোকমান হারিকেনের দিকে একটু এগিয়ে গেল। মনে হচ্ছে একা হয়ে যাওয়ায় সে খানিকটা ভয় পাচ্ছে। সিদ্দিকুর রহমান চোখ বন্ধ করে ফেললেন। তাঁর মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে। চোখ জ্বালা করছে। তিনি এই মুহুর্তে রমিলার কথা ভাবছেন। মাতা কি পুত্রের মৃত্যুসংবাদ পেয়েছেন? হঠাৎ তাঁর কাছে মনে হলো, মস্তিষ্ক বিকৃত থাকার কিছু সুবিধা আছে। পুত্রের মৃত্যুসংবাদ এই মস্তিষ্কবিকৃত মহিলা সহজভাবে গ্রহণ করবে। চিৎকার-কান্নাকাটি করবে না। ঘটনাটা হয়তো সে বুঝতেই পারবে না। এটা তার জন্যে মঙ্গলজনক।
লোকমান!
জি চাচাজি?
মাসুদের মাতাকে কি মৃত্যুসংবাদ দেয়া হয়েছে?
চাচাজি, আমি জানি না। খোঁজ নিয়া আসি।
খোঁজ নিয়া আসার প্রয়োজন নাই। আমি নিজেই যাব।
হুক্কা ঠিক করে দিব চাচাজি? আগুন নাই।
দাও, হুক্কা ঠিক করে দাও।
লোকমান প্ৰায় বিড়বিড় করে বলল, বাংলাঘরে অনেক লোক আসছে। আপনের সঙ্গে কথা বলতে চায়।
সিদ্দিকুর রহমান বললেন, কথা বলার কিছু নেই। তারা যেন এইদিকে না। আসে।
জি আচ্ছা।
পরীবানুর বাড়ি থেকে কেউ এসেছে?
উনার পিতা এসেছেন।
তাকে ভিতর-বাড়িতে নিয়ে যাও। মেয়ের সঙ্গে কথা বলায়ে দাও।
জি আচ্ছা।
মরাবাড়িতে তিনদিন তিনরাত চুলা জ্বালানো হয় না। চুলা যেন না জ্বালানো হয়।
জি আচ্ছা।
আশেপাশের বাড়ি থেকে মরাবাড়িতে খানা পাঠায়। এই বাড়িতে কেউ যেন খানা না পাঠায়।
জি আচ্ছা।
লোকমান কল্কেতে আগুন ধরিয়ে দিল। সিদ্দিকুর রহমান হুক্কার নিলে একটা টান দিয়েই উঠে দাঁড়ালেন। রমিলার সঙ্গে কথা বলা দরকার। মাতাকে পুত্রের মৃত্যুসংবাদ দেয়া প্রয়োজন। তার মন বলছে, এই সংবাদ রমিলা এখনো পায় নাই। লোকমান তার পেছনে পেছনে আসছিল। তিনি লোকমানকে বললেন, তুমি বাংলাঘরে যাও। যারা এসেছেন তাদের দেখভাল করো। পান-তামাক দাও।
রমিলার ঘরের সামনের হারিকেনটা এখন জ্বালানো হয়েছে। হারিকেনের আলোয় দেখা যাচ্ছে, রমিলা জানালার শিক ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। সিদ্দিকুর রহমানকে দেখেই তিনি মাথায় কাপড় তুলে দিলেন।
সিদ্দিকুর রহমান বললেন, কেমন আছ?
রমিলা বললেন, ভালো আছি। আপনার শরীর কেমন?
সিদ্দিকুর রহমান বললেন, আমার শরীর ভালো। বাড়িতে একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে, এই খবর কি পেয়েছ?
রমিলা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন। সিদ্দিকুর রহমান বললেন, খবর কে দিয়েছে?
রমিলা বললেন, আমি একজনের কাছ থেকে খবর পেয়েছি। তার নাম আপনেরে বলব না। আপনি মাসুদের বিষয় নিয়া অস্থির হবেন না। এখন অস্থির হওয়ার সময় না।
তুমি অস্থির না?
না। সবেই সবের কপাল নিয়া আসে। মাসুদ তার কপাল নিয়া আসছে। তার কপালে যা ছিল তা-ই ঘটেছে। আল্লাহপাকের এইরকম ইচ্ছা ছিল।
সিদ্দিকুর রহমান বললেন, তুমি যা ভেবেছ তা ভাবলে মনে শান্তি পাওয়া যায়। কিন্তু ঘটনা সেরকম না। মানুষ নিজে তার কপাল তৈরি করে। এই স্বাধীনতা আল্লাহপাক মানুষকে দিয়েছেন।
রমিলা বললেন, মানুষের ভাগ্যে যা লেখা তার অতিরিক্ত কোনোকিছু করার ক্ষমতা তার নাই। এই বিষয়টা আমার মতো ভালো কেউ জানে না। আপনে যদি চান আপনারে বুঝায়ে বলতে পারি।
সিদ্দিকুর রহমান বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছেন। এই মুহূর্তে রমিলাকে তাঁর কাছে মনে হচ্ছে অত্যন্ত সুস্থ একজন মহিলা, যে-মহিলা জটিল তর্ক শুরু করতে পারে এবং তর্ক এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। তিনি রমিলার জানালার কাছে এগিয়ে গেলেন। কোমল গলায় বললেন, তোমার খাওয়াদাওয়া কি হয়েছে?
রমিলা বললেন, জি না। আইজ রাইতে আমি কিছু খাব না। আমি উপাস দিব।
সিদ্দিকুর রহমান বললেন, তুমি যদি চাও আমি তোমার ঘরের দরজার তালা খুলে দিব। তুমি লীলার সঙ্গে থাক। লীলার মন ভালো হবে। সে বড়ই অস্থির হয়ে আছে।
রমিলা বললেন, আপনি লীলার কথা বললেন। তার মন ঠিক করার ব্যবস্থা নিলেন, কিন্তু মাসুদের স্ত্রীর বিষয়ে কিছু বললেন না। তার মন ঠিক করার বিষয়ে কিছু ভেবেছেন?
না।
যান, তার মনটা ঠিক করে দেন।
কীভাবে ঠিক করব?
রমিলা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে স্পষ্ট গলায় বললেন, আপনি তার কাছে যান। তার মাথায় হাত রেখে শুধু মা বলে একবার ডাকেন।
তাতেই মন ঠিক হবে?
হুঁ। মা বলে ডাক দিলে মেয়েটা কাঁদতে শুরু করবে। বড় কষ্ট পেলে মনে বিষ তৈরি হয়। তখন যদি কেউ কাঁদে, মনের বিষ চোখের পানির সঙ্গে বের হয়ে যায়।
বাহ, ভালো বলেছ। এইসব কি নিজে নিজেই বের করেছ, না কেউ তোমাকে আগে বলেছে?