লীলা বিছানায় শুয়ে পড়তে পড়তে বলল, তুমি আসলে আমার কাছ থেকে কিছু শেখ নি। কিন্তু এটা বলতে লজ্জা পাচ্ছি। ভাবিছ এটা শুনলে আমার মন খারাপ হবে। এইজন্যে বলেছ— কী শিখেছি। এটা আপনাকে বলব না। পরী, আমি কি ঠিক বলেছি?
পরী কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর শান্ত গলায় বলল, জি, ঠিক বলেছেন। আপনার সঙ্গে কথা বলার সময় মনে থাকে না যে আপনার অনেক বুদ্ধি। বুবু, আপনার মাথায় হাত বুলিয়ে দেই?
দাও, কিন্তু তোমার দাদির মতো ঘুম পাড়িয়ে দিও না। আমি অবেলায় ঘুমাতে চাই না।
পরী খাট ছেড়ে নামল। লীলা বলল, কোথায় যাচ্ছ? পারী বলল, আমার হাত দুটা কিছুক্ষণ ঠাণ্ডা পানিতে ড়ুবিয়ে রাখব। তখন হাত ঠাণ্ডা হবে। ঠাণ্ডা হাত কপালে রাখলেই দেখবেন আপনার খুব আরাম লাগছে।
এই বুদ্ধিও কি তোমার দাদির কাছ থেকে শেখা?
জি।
পরী তার বুদ্ধি প্রয়োগ করতে পারল না। তার আগেই লোকমান এসে বলল, মাস্টার সাব লীলা বইনজির সঙ্গে কথা বলতে চান।
আনিস মাস্টার দেশে চলে যাবে, সে এই প্ৰস্তৃতি নিয়ে বড়বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে আছে। তার সঙ্গে সুটকেস-ট্রাংক। দড়ি দিয়ে বাধা বইপত্র। লীলা অবাক হয়ে বলল, আপনি কোথায় যাচ্ছেন?
দেশে চলে যাচ্ছি। শরীরটা এখন ভালো। মার সঙ্গে অনেক দিন দেখা হয়। না। মার শরীরও ভালো না।
লীলা বলল, বাবা কি জানেন। আপনি চলে যাচ্ছেন?
জি, উনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এসেছি।
আপনি আবার ফিরে আসছেন তো?
জি না। গ্রামে আমার মন টেকে না। দেখি শহরে কিছু করতে পারি কি না। তাছাড়া…
তা ছাড়া কী?
এখানে কলেজে অনেক দিন শিক্ষকতা করলাম। বেতন পাই না।
ছাত্র কম। আদায়পত্র নাই। নাম কামাবার জন্যে লোকজন স্কুল-কলেজ দেয়, পরে আর চালানোর ব্যবস্থা করে না।
লীলা বলল, আপনার ট্রেন কখন?
দেড় ঘণ্টার মতো সময় হাতে আছে। আপনার সঙ্গে কথা শেষ করে রওনা দেব।
আমার সঙ্গে কথা শেষ হয়েছে। এখন রওনা দিতে পারেন।
আনিস বলল, আপনার সঙ্গে কথা শেষ হয় নি। জরুরি কিছু কথা ছিল।
বলুন, শুনছি।
আনিস বলল, দয়া করে আমার কথা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবেন।
লীলা বলল, আমি সবার সব কথাই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করি। আপনি কোন প্রসঙ্গে কথা বলবেন?
মাসুদ প্রসঙ্গে।
বলুন।
আপনি নিশ্চয়ই জানেন মাসুদ আছরের ওয়াক্তে ফাঁস নেবার কথা বলেছে। সবাই তার কথা শুনছে। মজা পাচ্ছে। কেউ তার কথা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে না।
আপনার ধারণা— তার কথা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত?
জি।
আপনার ধারণা— সে সত্যি সত্যি ফাঁসিতে ঝুলবো?
সম্ভাবনা আছে।
সম্ভাবনা আছে— কেন বলছেন?
আনিস শান্ত গলায় বলল, তার ভেতরে প্রচণ্ড রাগ তৈরি হয়েছে। ক্ষোভ আছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অভিমান। আপনি আপনার বাবাকে বলে তাকে বের করে আনুন। আপনার কাছে এটা আমার বিশেষ অনুরোধ। এইটুকুই আমার কথা। আমি আপনার বাবাকে আমার কথা বলার চেষ্টা করেছি। উনি ধমক দিয়ে থামিয়ে দিয়েছেন। আপনাকে ধমক দিয়ে থামাবেন না। আপনার কথা উনি অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবেন। আমার কথা শেষ হয়েছে, এখন আমি যাই।
আচ্ছা যান।
আনিস বলল, আপনি আমার উপর কোনো রাগ রাখবেন না। লীলা বিস্মিত হয়ে বলল, আমি আপনার উপর রাগ রাখব কেন? আমি রাগ করতে পারি। এমন কিছু কি আপনি করেছেন?
আনিস কিছু বলছে না, হতাশ মুখে দাঁড়িয়ে আছে। সে কথার পিঠে কথা বলতে পারে। আজি বলতে পারছে না। সব কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
আনিস ইতস্তত করে বলল, আমি কি আমার ঠিকানাটা আপনার কাছে দিয়ে যাব?
লীলা বলল, আমার কাছে ঠিকানা দিয়ে যাবেন কেন? আপনার ঠিকানা দিয়ে আমি কী করব?
আনিস খুবই বিব্রত হলো। লীলা বলল, আপনি বরং একটা কাজ করুন। বাবার কাছে ঠিকানা রেখে যান। উনার কোনো দরকার হলে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন।
আনিস বলল, মাসুদের কথাটা মনে রাখবেন।
হ্যাঁ, আমি মনে রাখব। ভালো কথা, মাসুদের ব্যাপারটা নিয়ে আপনি এত চিন্তিত, আপনার কি দেখে যাওয়া উচিত না সে কী করে? আছরের ওয়াক্ত পার করে গেলে হয় না?
আনিস বলল, জি-না হয় না। যদি সত্যি সত্যি কিছু ঘটে যায় সেটা আমি নিতে পারব না।
সে জন্যেই পালিয়ে যেতে চাচ্ছেন?
আনিস বিড়বিড় করে বলল, অন্য একটা কারণও আছে, কারণটা আপনাকে বলব না।
লীলা বলল, ঠিক আছে বলতে হবে না। চলে যান। শরীরের দিকে লক্ষ রাখবেন। দুদিন পর পর অসুখ বাঁধিয়ে যূথি নামের একজনকে ডাকাডাকি করা কোনো কাজের কথা না।
সিদ্দিকুর রহমান খেতে বসেছেন। লীলা তার সামনে বসে আছে। খাবার সময় তিনি কথাবার্তা বলা পছন্দ করেন না। নিঃশব্দে খেয়ে যান। রান্না ভালো বা মন্দ এই নিয়ে কখনো উচ্চবাচ্য করেন না। খাওয়া শেষ করেন অতিদ্রুত। শুধু শেষ পাতে তার টক দই লাগে। টক দই-এ গুড় মাখিয়ে আরাম করে খান। আজও তা-ই করলেন। তিনি অতিদ্রুত টক দই-এ চলে এলেন। লীলা একটি কথাও বলল না। নিঃশব্দে বসে রইল।
সিদ্দিকুর রহমান হাত ধুতে ধুতে বললেন, মা, বলো কী বলবে?
লীলা সামান্য বিস্মিত হলো। তার হাবভাবে এক মুহুর্তের জন্যেও প্রকাশ পায় নি সে কিছু বলতে চায়। অতি বুদ্ধিমান এই মানুষটি কিন্তু ধরতে পেরেছেন।
মাসুদের ব্যাপারে কিছু বলতে চাও?
জি।
ঢাক-ঢোল পিটায়ে কেউ মরতে যায় না। ঘরে তার নতুন বউ। নতুন বউয়ের পেটে সন্তান। এই অবস্থায় কেউ দড়িতে ঝুলে না। তুমি এইসব নিয়ে দুশ্চিন্তা করবে না। মাস্টার তোমার মাথায় এই জিনিস ঢুকায়েছে। মাস্টারের বেশির ভাগ চিন্তা-ভাবনা ভুল।