সিদ্দিকুর রহমান হাঁটতে শুরু করলেন। রেললাইনের পাশেই বন। বনের ভেতর জমাটবাঁধা অন্ধকার। সেখানে জোনাকি পোকা জুলছে। একটা-দুটা জোনাকি না— শত শত জোনাকি। একসঙ্গে এত জোনাকি তিনি অনেকদিন দেখেন নি। শেষ কবে দেখেছিলেন মনে করার চেষ্টা করলেন। তাও মনে পড়ছে না। শুধু মনে আছে, তিনি ঘন জঙ্গলের ভেতর দাঁড়িয়ে আছেন। চারদিকে শত শত জোনাকি। কিছু জোনাকি তার নাকে-মুখে এসে পড়তে শুরু করল। জোনাকির শরীর থেকে ঝাঝালো গন্ধ নাকে এসে লাগছে। কবে ঘটেছে এই ঘটনা? কবে?
কেউ কি রেললাইনে বসে আছে? সে-রকমই তো মনে হচ্ছে। সিদ্দিকুর রহমানের হাতে টর্চ। টর্চের আলো ফেললেই ঘটনা। কী বুঝা যায়। কিন্তু তাঁর টর্চের আলো ফেলতে ইচ্ছা করছে না। জিন ভূত না তো? অঞ্চলটা খারাপ। অনেকেই কী সব দেখেছে–রেললাইন ধরে হেঁটে যায়। শিস বাজায়।
সিদ্দিকুর রহমান আরো কিছুদূর গেলেন। যে বসেছিল। সে উঠে দাঁড়িয়েছে। জিন হলে উঠে দাড়াত না। কুয়াশায়ে মিলিয়ে যেত।
কে?
ছায়ামূর্তি বলল, স্যার আমি।
এখানে কী করো?
ছায়ামূর্তি জবাব দিল না। মনে হয় তার কাছে জবাব নেই। সিদ্দিকুর রহমান এগিয়ে গেলেন। ছায়ামূর্তি স্পষ্ট হলো। সে তার হাতের জ্বলন্ত সিগারেট ফেলে দিল।
ছায়ামূর্তির নাম আনিস। সিদ্দিকুর রহমানের দুই মেয়ের জায়গির মাস্টার। এই লোকের একা একা রেললাইনে বসে থাকার অভ্যাস আছে সিদ্দিকুর রহমান জানতেন না। তাকে নিরীহ গোবেচারা ধরনের মানুষ বলেই জানতেন।
এখানে কী করছো?
কিছু করছি না। বসে ছিলাম।
তুমি কি প্রায়ই এদিকে আসো?
আনিস জবাব দিল না। সিদ্দিকুর রহমান বললেন, চলো আমার সঙ্গে। হাঁটি।
রেললাইনের পাশ দিয়ে হাঁটাপথ। চাঁদের আলোয় রেললাইন চকচক করছে, সেই সঙ্গে পায়ে চলা পথও চকচক করছে। সিদ্দিকুর রহমান আগে আগে যাচ্ছেন। আনিস তার পেছনে। আনিসের গায়ে ছাইরঙা চাঁদর। দূর থেকে চাঁদরটা সাদা দেখাচ্ছিল। এর কী কারণ হতে পারে? সিদ্দিকুর রহমানের মাথায় এই প্রশ্ন ঘুরছে।
আনিস!
জি স্যার।
বাংলা তারিখ কত?
কার্তিকের ছয় তারিখ। তেরশ সাতান্ন।
পড়েছিল। তিনি হাতের ইশারায় তাকে কাছে ডাকলেন। ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তোমার সঙ্গে কি সিগারেট আছে?
আনিস অপ্ৰস্তৃত গলায় বলল, জি আছে।
সিদ্দিকুর রহমান বললেন, দাও একটা সিগারেট খাই।
আনিস সিগারেটের প্যাকেট এগিয়ে দিল। অতি সস্তার বিক সিগারেট। সিদ্দিকুর রহমানের মতো মানুষের হাতে এই সিগারেট দেওয়া যায় না।
মাস্টার শোনো, আজ থেকে তিনশ বছর আগে আমার পূর্বপুরুষ এই অঞ্চলে এসেছিলেন। তার নাম নওরোজ খাঁ। পাঠান বংশের মানুষ। তাঁর সঙ্গে ছিল তার স্ত্রী এবং পাঁচ বছর বয়সের ছোট্ট একটা মেয়ে। মেয়েটার নাম লীলাবতী। নওরোজ খ্যা ঘন জঙ্গলের ভিতর ঘর বানিয়ে স্ত্রী এবং মেয়েটাকে নিয়ে থাকতেন। মেয়েটা কালাজ্বরে মারা যায়। জঙ্গলের ভিতর কোথাও তার কবর আছে।
আনিস কিছু বলল না। তার মাথায় একটা প্রশ্ন এসেছে। সিদ্দিকুর রহমানের নামের শেষে খা নাই কেন? প্রশ্নটা সে করল না। জায়গির মাস্টারের মুখে প্রশ্ন মানায় না। সিদ্দিকুর রহমান সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে কাশলেন। কাশির বেগ কমে এলে বললেন, আমার বড় মেয়ের নাম যে লীলাবতী এটা কি তুমি জানো?
জি না।
তার মা মেয়ের ওই নাম রেখেছিল। আমার কাছে গল্প শুনেই বোধহয় রেখেছে। নামটা সুন্দর না?
জি স্যার।
ডাক নাম লীলা। ভালো নাম লীলাবতী।
আনিস বলল, হিন্দু ধরনের নাম— লীলাবতী, কলাবতী।
সিদ্দিকুর রহমান বললেন, এটা ঠিক বলেছ। হিন্দুয়ানি নাম। আমার মাথায়ও এই প্রশ্ন এসেছে। নওরোজ খাঁ নামের এক পাঠান। তার মেয়ের নাম লীলাবতী রাখবে কেন?
আনিস বলল, হয়তো এই মেয়ে তার নিজের ছিল না। মেয়েটা হিন্দু ছিল। উনি তাকে চুরি করে নিয়ে এসেছেন। তিনশ বছর আগে আইনকানুন কিছু তো ছিল না।
সিদ্দিকুর রহমান হাঁটা বন্ধ করে মাস্টারের দিকে তাকালেন। ছেলেটা গুছিয়ে কথা বলছে তো!
মাস্টার।
জি।
সন্ধ্যার সময় রেললাইনের উপর বসেছিলে কেন?
স্যার আপনাকে আরেক দিন বলব।
ঠিক আছে আরেক দিন শুনব।
আনিস বলল, আপনার সিগারেট খাওয়া দেখে সিগারেটের তৃষ্ণা হয়েছে। আপনি যদি অনুমতি দেন একটা সিগারেট ধরাব।
ধরাও।
আর যদি বেয়াদবি না নেন। তাহলে আরেকটা কাজ করব।
কী কাজ?
রেললাইনের উপরে বসে থাকব।
থাকো। বসে থাকো।
সিদ্দিকুর রহমান এগিয়ে যাচ্ছেন। একবার পেছনে ফিরলেন— আনিস মাস্টার যে রেললাইনে বসে আছে সেটা দেখা যাচ্ছে না। তবে তার ঠোঁটের জুলন্ত সিগারেটের আগুন দেখা যাচ্ছে।
আমার নাম আনিস
আমার নাম আনিস। আনিসুর রহমান।
এই অঞ্চলে আমার অনেকগুলি নাম আছে— কুঁজা মাস্টার, গুঁজা মাস্টার। কুঁজা হয়ে হাঁটি এইজন্যে কুঁজা মাস্টার। কলেজের প্রিন্সিপ্যাল গণি সাহেব আমাকে ডাকেন ভোঁতা-মাস্টার। সবসময় মুখ ভোঁতা করে রাখি বলে এই নাম। হ্যাঁ, আমি সবসময় মুখ ভোঁতা করে রাখি। মাঝে মাঝে মুখ ভোঁতা করে রেললাইনে বসে ভাবি— একটা ট্রেন এসে গায়ের উপর দিয়ে চলে গেলে কেমন হয়?
রেলগাড়ি ঝমাঝম
ভোঁতা মাস্টার আলুর দাম।
না হয় নাই, ছড়াটা আরো লম্বা–
আইকম বাইকম তাড়াতাড়ি
ভোঁতা মাস্টার শ্বশুরবাড়ি
রেলগাড়ি ঝমাঝম
ভোঁতা মাস্টার আলুর দাম।
আলুর দাম হওয়া খারাপ কিছু না। সব সমস্যার সমাধান। আমার সমস্যা ভালো লাগে না, এইজন্যেই আমি সমস্যার ভিতর থাকি। যে যার নিন্দে, তার দুয়ারে বসে কান্দে। যে যা পছন্দ করে না তাকে তার মধ্যে থাকতে হয়। যেসব মানুষ আমি পছন্দ করি না— তারা থাকে আমার আশেপাশে। যেমন সিদ্দিকুর রহমান।