আপনি কোরআন শরীফের সূরার অর্থ জানেন?
আমি জানি না গো মা। আমাদের এক হুজুর ছিলেন বিরাট আলেম। উনার কাছে যখন সবক নিতাম উনি সূরা ব্যাখ্যা করতেন।
তাহলে আমাদের তাড়াহুড়া করা উচিত না?
না গো মা।
আমাদের উপর যখন বিরাট বিপদ এসে পড়বে তখনো আমরা অস্থির হবো না?
না।
আপনি তো অনেক কথা আগে আগে বলতে পারেন— আপনার কি মনে হয় আমাদের উপর বড় বিপদ আসবে?
সবসময় বলতে পারি না মা। মাঝে মাঝে পারি।
এখন কিছু বলতে পারছেন না?
না। আল্লাহপাক মাঝে মাঝে আমাদের সাবধান করার জন্য বিপদের কথা আগেই জানান। মাঝে মাঝে তিনি চান না। আমরা সাবধান হই। তিনি চান যেন আমরা বিপদে পড়ি।
লীলা বলল, আপনার ব্যাখ্যা সুন্দর। এমনভাবে বলেন যে বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে।
রমিলা বলল, আমার হুজ্বর ছিলেন উনি এইভাবে কথা বলতেন। উনার কাছ থেকে এইভাবে কথা বলা শিখেছি।
লীলা বলল, আমি এইবার ঢাকা যাওয়ার সময় আপনাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাব। আপনার চিকিৎসা করাব।
রমিলা বললেন, মাগো, তুমি তো ইনশাল্লাহ বললা না। আল্লাহপাকের ইচ্ছা হইলেই তুমি আমারে নিতে পারবা। উনার ইচ্ছা বিহনে পারব না।
লীলা বলল, আপনার ঘরের তালা খুলে দেই? আসুন আমরা বাগানে হাঁটি?
রমিলা বললেন, তোমারে একটা সিমাসা দিব। যদি ভাঙ্গাইতে পারো তাহলে তোমার সঙ্গে হাঁটতে যাব। না পারলে যাব না।
সিমাসাটা কী?
এক পাখি নড়েচড়ে
দুই পাখি খায়
তিন পাখি নাওএ বসা
চার পাখি নাও বায়।
লীলা বলল, পারব না। রমিলা জানালার পাশ থেকে সরে গেলেন।
মাসুদ আছর ওয়াক্তে ফাঁস নেবে–এই ব্যাপারটা অতি দ্রুত জানাজানি হয়ে গেছে। সবার মধ্যে চাপা উত্তেজনা। কেউ বিশ্বাস করছে না, আবার পুরোপুরি অবিশ্বাসও করছে না। পরীবানুর মধ্যে কোনোরকম চাঞ্চল্য লক্ষ করা গেল না। সে তার নিজের ঘরে খাটের উপর আধশোয়া হয়ে বই পড়ছে। তার প্রধান কাজ এখন বই পড়া। এই বাড়িতে বেশকিছু বই আছে। শরৎ, বঙ্কিমচন্দ্র, যোগেন্দ্রনাথ গ্রন্থাবলি। সকালবেলা সে আলমিরা থেকে একটা বই বের করে বসে। পড়তে পড়তে বারবার তার চোখে পানি আসে। আনন্দের কোনো ঘটনাতেও পানি আসে। দুঃখের ঘটনাতেও পানি আসে। নিজের ঘর ছেড়ে তাকে বাইরে বের হতে দেখা যায় না। তার স্বামীকে একটা ঘরে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে, এটা ভেবেই সে হয়তো নিজেকে স্বেচ্ছায় নির্বাসনে রেখেছে। তবে মাসুদের ব্যাপারে। সে কারো সঙ্গেই কোনো কথা বলে না।
লীলা যখন তার ঘরে ঢুকল সে তখন খাটে শুয়ে আছে। তার বুকের উপর মীর মশাররফ হোসেনের বিষাদসিন্ধু। লীলাকে ঘরে ঢুকতে দেখে সে উঠে বসল। বই একপাশে রেখে লীলার দিকে তাকিয়ে বলল, বুবু, আপনার কি জ্বর এসেছে? চোখ লাল।
লীলা বলল, জ্বর আসতে পারে। মাথা ধরেছে।
পরী হাত বাড়িয়ে লীলার হাত ধরল। জ্বর দেখার জন্যে হাত ধরা। কিন্তু সে হাত ছেড়ে দিল না। হাত ধরেই থাকল।
লীলা বলল, কী দেখলে, আমার গায়ে কি জ্বর আছে?
জি আছে। বেশি না, অল্প। কিন্তু জ্বর বাড়বে।
কীভাবে বুঝলে?
শরীর অল্প অল্প কাপতেছে। যতক্ষণ শরীর কাপে ততক্ষণ জ্বর বাড়ে। এটা আমি আমার দাদাজানের কাছে শিখেছি। উনি কবিরাজ ছিলেন। বুবু বসেন।
লীলা বসল। পরী বলল, আপনের ভাই নাকি ঘোষণা দিয়েছে। ফাঁস নিবে?
লীলা কিছু বলল না। পরী নিজের মনে মিটমিটি হাসছে। লীলা বিস্মিত হয়ে দেখল— মেয়েটার হাসি খুবই সুন্দর।
পরী বলল, আপনার ভাইয়ের মাথা খুব গরম। যখন মাথা বেশি গরম হয়ে যায়। তখন কেউ মাথা ঠাণ্ডা করতে পারে না।
তুমিও পারো না?
আমি পারি। তার মাথা ঠাণ্ডা করার মন্ত্র আমি বের করেছি।
লীলা বলল, কী মন্ত্ৰ— আমাকে শিখিয়ে দাও। মন্ত্র পড়ে আমি মাথা ঠাণ্ডা করে দিয়ে আসি।
এই মন্ত্র আপনি পড়লে কাজ হবে না। আমার পড়তে হবে।
যাও, তুমি পড়ে দিয়ে আসো।
পরী বলল, না। আমি যাব না।
পরীর হাসিহাসি মুখ হঠাৎ কঠিন হয়ে গেল। সেই কাঠিন্য স্থায়ী হলো না। মুখ স্বাভাবিক হলো। ঠোঁটের কোনায় অস্পষ্ট হাসি ফিরে এলো। পরী বলল, বুবু, আপনি নাকি ঢাকায় চলে যাবেন?
লীলা বলল, হ্যাঁ।
করে যাবেন?
বাবার সঙ্গে কথা বলে ঠিক করব। যত তাড়াতাড়ি যেতে পারি, আমার জন্যে তত ভালো।
বুবু, যদি রাগ না করেন। আপনাকে একটা কথা বলি?
বলো।
আমাকে আপনার সঙ্গে নিয়ে যান। আমি কয়েকটা দিন আপনার সঙ্গে থেকে আসি। এখানে আমি একা একা থেকে কী করব? একটা মানুষ থাকবে না। যার সঙ্গে আমি দু’টা কথা বলতে পারব। আপনার সঙ্গে যাওয়া কি সম্ভব?
না।
পরী খুব স্বাভাবিকভাবে বলল, আচ্ছা ঠিক আছে।
লীলা বলল, তুমি যাতে তোমার বাবা-মা’র সঙ্গে গিয়ে কিছুদিন থাকতে পারো আমি সেই ব্যবস্থা করতে পারি।
পরী শান্ত গলায় বলল, আমাকে এ-বাড়ি থেকে ছাড়বে না। আপনার ভাইকে তালাবন্ধ করে আটকে রেখেছে। আমাকে তালা ছাড়া আটকে রেখেছে। জিনিস একই। বুবু, আপনার জ্বর তো আরো বেড়েছে, আপনি আমার ঘরে শুয়ে থাকেন। আমি কপালে হাত বুলিয়ে দেই। আমি খুব ভালো মাথা মালিশ করতে পারি। মাথা মালিশ করা আমি শিখেছি আমার দাদির কাছে। আমার দাদি মাথা মালিশ করে যে-কাউকে দশ মিনিটের মধ্যে ঘুম পাড়ায়ে দিতে পারতেন।
লীলা বলল, তুমি দেখি অনেকের কাছে অনেক জিনিস শিখেছ।
আমি সবার কাছ থেকেই কিছু-না-কিছু শেখার চেষ্টা করি।
আমার কাছ থেকে কী শিখেছ?
আপনার কাছ থেকে অনেক বড় একটা জিনিস শিখেছি। কিন্তু কী শিখেছি সেটা এখন আপনাকে বলব না।