জিনের দোজখ যে পানি দিয়া তৈয়ারি এইটা কি জানেন ভাইজান? আগুনের দোজখে এরার কিছু হবে না। নিজেরাই তো আগুনে তৈয়ার। এই জন্যে আল্লাহপাক তারার জন্য বানায়েছেন পানির দোজখ। সেই দোজখে হাঁটু পানি। চব্বিশ ঘণ্টা বৃষ্টি হয়। বৃষ্টির পানি বরফের মতো ঠাণ্ডা।
জিনের খাওয়া খাদ্য কী জানেন ভাইজান? প্রধান খাদ্য ছানার মিষ্টি। ভূতপ্রেতের প্রধান খাদ্য মাছ ভাজা। সব মাছ না— শউল মাছ। শউল মাছের পরেই বোয়াল মাছ।
বদু কথা বলেই যায়, মাসুদ শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সে গল্প শুনছে। এরকম মনে হয় না, আবার শুনছে না। এরকমও মনে হয় না। মাঝে মাঝে সে হঠাৎ করেই বন্দুকে থামিয়ে দিয়ে চাপা গলায় বলে— বদু একটা কাজ করেন। পরী কোথায় আছে একটু দেখে আসেন।
এখন যাব?
হ্যাঁ, এখন যান।
কিছু বলা লাগবে?
কিছু বলা লাগবে না, শুধু দেখে আসেন।
বদু গল্প বলায় সাময়িক বিরতি দিয়ে খোঁজ নিতে যায়। আবার ফিরে এসে গল্প শুরু করে। জিন-ভূত-প্ৰেত বিষয়ক গল্প। জুম্মাঘরের কাছে তেঁতুল গাছে যে পেত্নী থাকে তার গল্প বদু খুব আগ্রহের সঙ্গে করে। কারণ এই পেত্নীটাকে বদু নিজেও কয়েকবার দেখেছে। পেত্নীর নাম কলন্দির বিবি। সে অনেক দিন থেকেই না-কি তেঁতুল গাছে বাস করছে।
ভাইজান শুনেন, তেঁতুল গাছটা নজর কইরা কোনোদিন দেখছেন? তেঁতুল গাছে তেঁতুল হবে এইটাই জগতের নিয়ম। এই গাছে ফুল আসে। কিন্তু তেঁতুল হয় না। ঘটনা বুঝতেছেন তো? কোনো পাখি দেখছেন এই গাছে বসেছে? দেখেন নাই। কারণ একটাই কলিন্দর বিবি। তিনবার তার সাথে আমার দেখা হয়েছে। একবার তো মরতেই বসছিলাম। সেই গল্পটা শুনেন।
জানালার দুপাশে দুজন
জানালার দুপাশে দুজন।
একপাশে মাসুদ। অন্য পাশে লীলাবতী। মাসুদ জানালার শিক ধরে দাঁড়িয়ে আছে। লীলা জানালার পাশে চেয়ার টেনে বসেছে। লীলার মুখ বিষণ্ণ। তার কিছুই ভালো লাগছে না। নিজেকে এই বাড়ির সঙ্গে জড়ানো ভুল হয়েছে–এমন একটা চিন্তা মাথায় ঢুকেছে। বাড়িটা যেন অদৃশ্য সুতায় তাকে ধরে রেখেছে। অদৃশ্য সুতা কাটতে যে কাচি লাগে সেই কাচি তার কাছে নেই।
মাসুদ বলল, বুবু, দরজা খুলে দাও।
লীলা বলল, আমার কাছে চাবি নাই।
মাসুদ বলল, তালা ভাঙার ব্যবস্থা করো। আজি দুপুরের মধ্যে যদি আমাকে বের না করো আমি কিন্তু ঘটনা ঘটাব।
কী ঘটনা?
মাসুদ জবাব দিল না। তার চোখ জ্বলজ্বল করছে। নাকে বিন্দু বিন্দু ঘাম। রাগে তার শরীর কাঁপছে। জানালার শিক ধরে সে শরীরের কাপুনি থামানোর চেষ্টা করছে। তার গায়ের হালকা সবুজ রঙের পাঞ্জাবি ঘামে ভেজা।
বুবু, আমি কিন্তু সত্যি ঘটনা ঘটাব।
লীলা উঠে দাঁড়াল। তার বসে থাকতে ভালো লাগছে না। মাসুদ বলল, বুবু, চলে যাচ্ছ কেন? তুমি যেতে পারবে না। বসো।
লীলা বলল, বসে থেকে কী করব?
আমি কিন্তু ঘটনা ঘটাব।
ঘটনা ঘটাতে চাইলে ঘটাও। আমাকে বলার দরকার কী?
মাসুদ তীব্র গলায় বলল, ঘটনা ঘটে গেলে কিন্তু তোমার উপরে দোষ পড়বে। কারণ তোমাকে আগে সাবধান করে দিয়েছিলাম। আমি ফাঁস নিব, দড়ি জোগাড় করেছি। দেখতে চাও?
লীলা কিছু বলল না। মাসুদ খাটের নিচ থেকে লম্বা দড়ির গোছা বের করে দেখাল। বেশ আগ্রহ নিয়েই দেখাল। শিশুরা তাদের পছন্দের খেলনা বড়দের যেমন আগ্রহ নিয়ে দেখায় সেরকম আগ্রহ। আগ্রহে উত্তেজনায় মাসুদের চোখ জ্বলজ্বল করছে।
ফাঁস কখন নিবে?
আছরের ওয়াক্তে। আছরের আজানের পর। বুবু, তুমি আমার কথা বিশ্বাস করতেছ না? আমি সত্যি ফাঁস নিব। আল্লাহর কসম, নবীজির কসম, পরীবানুর কসম। বুবু, তুমি এখনো আমার কথা বিশ্বাস করতেছ। না?
লীলা বলল, আমার বিশ্বাস করা না-করায় কিছু যায় আসে না।
বুবু, আমি জানি তুমি আমার কথা বিশ্বাস করতেছ না। কোরানশরিফ আনো, আমি কোরানশরিফ ছয়ে কসম কাটব। বুবু শোনো, পরীবানুর পেটে যে সন্তান আছে সেই সন্তানের কসম, আমি ফাঁস নিব। এইবার কি বিশ্বাস করেছ?
লীলা বলল, করেছি।
মাসুদ বলল, যাও এখন ব্যবস্থা নাও।
লীলা বের হয়ে এলো। তার মাথায় সূক্ষ্ম যন্ত্রণা হচ্ছে। আছর ওয়াক্তের অনেক দেরি আছে। অস্থির হবার কিছু নেই। তার আগেই অনেককিছু করা যাবে। কিন্তু লীলার অস্থির লাগছে। ঝামেলা এখনই শেষ করে দেয়া উচিত। লীলা তার বাবার খোজে বের হলো। তিনি মূল্যবাড়িতে নেই। শহরবাড়িতেও নেই। পাখিদের ধান খাওয়াতে গেছেন। লীলার একবার মনে হলো, সেও পাখির ধান খাওয়া দেখতে যাবে। বাবার সঙ্গে যা কথা বলার সেখানেই বলবে। তার একা যেতে ইচ্ছা করছে না, আবার কাউকে সঙ্গে নিতেও ইচ্ছা করছে না। বাড়ির সীমানার বাইরে যেতে হলে বোরকা পরতে হবে। এটা সিদ্দিকুর রহমান সাহেবের সাম্প্রতিক নির্দেশ। লীলা যে বোরকা পরে নি তা-না। কিন্তু বোরকা পরলেই কেমন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।
লীলা বাড়ির বারান্দায় হাঁটছে। মন শান্ত করার ব্যাপারে। হাঁটা ভালো কাজ করে। কেন করে কে জানে!
লীলা আম্মাজি!
রমিলা ডাকছেন। তাঁর গলার স্বর নিচু। ডাকছেন মমতা নিয়ে। লীলা রমিলার ঘরের জানালার পাশে দাঁড়াল। রমিলা বললেন, মা, তোমাকে অস্থির লাগাতেছে কেন?
লীলা জবাব দিল না।
রমিলা বললেন, কোনো বিষয়ে অস্থির হওয়া ঠিক না মা। আল্লাহপাক মানুষের অস্থিরতা পছন্দ করেন না। কোরআন মজিদে উনি বলেছেন।
কী বলেছেন?
উনি বলেছেন, হে মানুষ! তোমাদের বড়ই তাড়াহুড়া।