আনিস দুপুর নাগাদ প্রবল জুরের ঘোরে চলে গেল। দিনের আলো কড়কড় করে চোখে লাগতে লাগল। নিঃশ্বাসেও কষ্ট। কানের ফুটো দিয়ে ভাপের মতো বের হচ্ছে। আলো চোখে লাগে বলে যতবারই সে চোখ বন্ধ করে ততবারই দেখে যূথিকে। যূথি অনেক অদ্ভুত কর্মকাণ্ড করছে— যেমন একবার দেখা গেল বড় একটা কলাপাতা নিয়ে কলাপাতা ছিড়ছে। কলাপাতার রঙ হয় সবুজ। এই কলাপাতাটা সোনালি রঙের। আরেকবার দেখল, কাসার জগে। সে যেন কী ঘুটছে, শব্দ হচ্ছে সাইকেলের ঘণ্টার মতো ক্রিং ক্রিং ক্রিং। আনিস বলল, কী বানাচ্ছিস? যূথি বলল, শরবত বানাচ্ছি। বেলের শরবত। খাবে? তারপর সে দেখল, যূথি শরবত বানানো বন্ধ করে কঠিন গলায় কথা বলছে। কাকে যেন আদেশ দিচ্ছে–মাথায় পানি ঢালতে শুরু করো। ডাক্তার না। আসা পর্যন্ত পানি ঢালতে থাকবে। আনিসের তখন মনে হলো–কঠিন গলায় যে কথা বলছে তার নাম যূথি না। তার নাম লীলাবতী।
মাথায় পানি ঢালা পর্ব শুরু হয়েছে। বদু পানি ঢালছে। বরফের মতো ঠাণ্ডা পানি। এরা কি বরফকল থেকে বরফ নিয়ে এসে পানির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে? পানি গন্ধহীন হবার কথা। এই পানির গন্ধ আছে। মাছ মাছ গন্ধ।
লীলাবতী বলল, আপনার কি খুব বেশি খারাপ লাগছে?
আনিস বলল, হঁ।
ডাক্তার আনতে লোক গেছে। ডাক্তার চলে আসবে। আপনি এক-দুই দিন পরে পরেই বিরাট অসুখ বাধাচ্ছেন। আপনার ভালো চিকিৎসা হওয়া উচিত।
আনিস বিড়বিড় করে বলল, আচ্ছা চিকিৎসা করাব। আপনি এখন চলে চলে যেতে বলছেন কেন?
আনিস জবাব দিল না। তবে সে মনে-প্ৰাণে চাচ্ছে মেয়েটা চলে যাকপানির আঁশটে গন্ধ পেটের ভেতর পাক দিচ্ছে। এক্ষুনি বমি হবে। এই মেয়েটার সামনে বমি করতে মন চাচ্ছে না। আনিস বলল, আপনি চলে যান। আপনি চলে যান। আপনি চলে যান। সে বলেছে মাত্র একবার কিন্তু আপনি চলে যান’ বাক্যটা মাথার ভেতর বেজেই চলছে। ঐ তো মেয়েটা চলে যাচ্ছে, এখন আর তাকে আপনি চলে যান বলার দরকার নেই। তারপরও সে বলে যাচ্ছে। আশ্চর্য তো!
লীলা শহরবাড়ি ছেড়ে মূল বাড়ির দিকে এগুচ্ছে। তবে সে মনস্থির করতে পারছে না— সে মূল বাড়িতে যাবে না-কি কিছুক্ষণ পুকুরঘাটে বসে থাকবে! পানির কাছাকাছি থাকলে মন শান্ত হয়। কে জানে, কেন হয়!
পরীবানু দিঘির জলে পা ড়ুবিয়ে একা একা বসে আছে। লীলাকে দেখতে পেয়েই সে হাত ইশারা করে ডাকল। আনন্দিত গলায় বলল, বুবু, একটা মজার জিনিস দেখে যাও। পরীবানুর এমন আনন্দিত গলা লীলা আগে শোনে নি। সে বিস্মিত হয়ে বলল, কী?
আমার মতো করে বসো বুবু, পানিতে পা ড়ুবাও, তারপর দেখবে।
কী দেখাব?
আগে বলব না। আগে বললে মজা চলে যাবে।
লীলা পা ড়ুবিয়ে বসল। আসলেই তো মজা। কড়ে আঙুলের মতো সাইজের মাছ এসে পায়ে ঠোকর দিচ্ছে। একটা দুটা মাছ না— অনেক মাছ।
লীলা বলল, এই মাছগুলোর নাম কী?
দাড়কিনি মাছ। এই পুষকুনিতে অনেক বড় বড় মাছ আছে। বুবু, তুমি কোনোদিন বর্শি দিয়ে মাছ ধরেছ?
না।
আসো না। আমরা একদিন বর্শি ফেলে মাছ ধরি। ধরবে?
লীলা বলল, তুমি কি পুকুরপাড়ে প্রায়ই আসো?
পরী বলল, হঁ।
কাঁদার জন্যে আসো?
পরী কিছু বলল না।
তোমার সারা মুখে কাজল লেপ্টে গেছে। পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে ফেলো।
পরী আজলা ভর্তি পানি মুখে ছিটাচ্ছে। লীলা সহজ গলায় বলল, ঘাটে বসে কাঁদার মতো কিছু হয় নাই। বাবার রাগ পড়ে যাবে। তুমি মাসুদের সঙ্গে সুখে দিন কাটাবে। কয়েকটা দিন কষ্ট করে পার করো।
উনার রাগ পড়বে না। উনি অন্যদের মতো না।
লীলা বলল, তোমার ধারণা বাবা সারাজীবন মাসুদকে আটকে রাখবে?
পরী কিছু বলল না। তার মুখের কাজল ধুয়ে গেছে, তারপরও সে মুখে পানি ছিটিয়ে যাচ্ছে।
লীলা বলল, মাসুদের সঙ্গে তোমার কথা হয় না?
পরী বলল, না। উনি আমাকে কথা বলতে নিষেধ করেছেন। আমি উনার নিষেধ মানছি।
মাসুদকে আটকে রাখা হয়েছে মূল বাড়ির শেষপ্রান্তে। ঘরের সামনে বদু বসে থাকে। তার দায়িত্ব বদুর উপর লক্ষ রাখা। রাতে বদু ঘরের সামনের বারান্দায় কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমায়।
দিন-রাতের বেশির ভাগ সময় মাসুদ বিছানায় চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকে। ঘরের ভেতর গুমোট গরম। এই গরমে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকা কষ্টের ব্যাপার। মাসুদকে দেখে মনে হয় না সে কষ্টে আছে। যতক্ষণ সে ঘুমায় না। ততক্ষণ খাটে পা ঝুলিয়ে বসে থাকে। বদু তার সঙ্গে মাঝেমধ্যে গল্প করতে আসে। বদু নিজের মনে কথা বলে যায়। এই বাড়ির কোথায় কী ঘটছে তা শোনায়। দায়িত্ব নিয়েই শোনায়। একজন মানুষ আটকা পড়ে আছে, কোথায় কী হচ্ছে কিছুই জানে না। তাকে জানানো প্রয়োজন।
ভাইজান শুনেন–আপনের পিতা কী করে শুনেন। জঙ্গলে বইসা থাকে। একলা যায়। কাউরে সাথে নেয় না। এইটা আচানক ঘটনা না? আপনে বলেন। আপনের নিজেরও তো একটা বিবেচনা আছে। আপনের বিবেচনা কী বলে— ঘটনা। কী? জিন সাধনার বিষয় আছে। যারা জিন সাধনা করে তারার একা কিছু সময় থাকতে হয়। এই সময় তারা জিনের সাথে কথা কয়।
আবার স্মরণ কইরা দেখেন আপনের পিতারে কি আপনে কোনোদিন পুযকুনিতে সিনান করতে দেখছেন? দেখেন নাই। ঘটনা কী বলেন দেখি। বিবেচনা কইরা বলেন। যারা জিন সাধনা করে তারা কি পুষকুনিতে সিনান করতে পারে? পারে না। নিয়ম নাই। তারারে সবসময় তোলা পানিতে সিনান করতে হয়।
এখন আপনারে বলি আরেক বিবেচনার কথা, যে বাড়িতে জিন সাধনা হয় সেই বাড়িতে সবসময় অসুখ-বিসুখ লাইগ্যা থাকবে। কুঁজা মাস্টারের কথাটা বিবেচনায় আনেন। তার কপালে অসুখ আছে কি-না এইটা বলেন। এখন তার জুরি। এমন জুরি যার মা-বাপ নাই। জ্বর কী জন্যে হয় জানেন? জিনের বাতাস লাগিলে হয়। জিনের শইল্যের বাতাস খুব ঠাণ্ডা। ঠাণ্ডা বাতাস শইল্যে লাগলেই হয়। জুর। ঘটনা কেমন আশ্চর্য চিন্তা করেন। একটা জিনিস আগুনের তৈয়ারি কিন্তুক তার বাতাস ঠাণ্ডা। আর আমরা মানুষ আমরারে পয়দা করা হইছে মাটি দিয়া। কিন্তুক আমরার শইল্যের বাতাস গরম। আশ্চর্য কি-না বলেন!