হুঁ। খুব বেশি ভালো পাও?
হুঁ।
তোমারে একটা উপদেশ দেই, মন দিয়া শোনো। নিকট আত্মীয়ের বাইরে কোনো পুরুষমানুষরে মেয়েদের বেশি ভালো পাওয়া উচিত না।
জইতরী বলল, উচিত না কেন?
মেয়েছেলের মন অন্যরকম। মেয়েছেলে সবসময় ভালো যারে পায় তারে নিয়া সংসার করতে চায়। তুমি যখন আরেকটু বড় হইবা তখন বুঝবা। এখন বুঝবা না। তুমি বড়পীর সাহেবের নামে কসম কাটছ, মঞ্জু নামের মানুষটার সাথে কথা বলবা না। কসম না ভাঙাই ভালো। কসম ভাঙাইবা না।
পরীবানু পা দোলাচ্ছে। তার আচার-আচরণ স্বাভাবিক। সে কথা বলার সময় জাইতরীর দিকে তাকাচ্ছেও না। কথা বলছে সহজ-স্বাভাবিক গলায়। অথচ এমনভাবে কথা বলছে যেন সে সবই জানে।
জইতরী।
হুঁ।
আমার কথায় তুমি কিছু মনে নিও না। আমার মন মিজাজ ভালো না। কখন কী বলি তার নাই ঠিক।
পরীবানু চোখ মুছল। সহজ-স্বাভাবিকভাবে যে মেয়ে কথা বলছিল মুহুর্তেই তার চোখে পানি। জাইতরী অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। পরীবানু চোখ মুছে হোসে ফেলে বলল—
ক্ষণেকে চোখে পানি ক্ষণেকে হাসি
সেই কন্যা হয় রাক্ষস রাশি।
নানান ধরনের পাখি খান খাচ্ছে
সিদ্দিকুর রহমান আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছেন।
নানান ধরনের পাখি খান খাচ্ছে। কাক, শালিক, কবুতর, টুনটুনি, সাতরা পাখি। গ্রামাঞ্চলে কাক থাকে না। এই দুই দাড়কাক কোত্থেকে এসেছে? তিনি আগ্রহ নিয়ে কাক দুটিকে দেখছেন। সাধারণ কাকের দ্বিগুণ আয়তন। চোখ টকটকে লাল। পাখিসমাজ এই দুজনকে সমীহের চোখে দেখছে। কাক দুটির উপর দিয়ে বিকট শব্দ করে অচেনা একটি পাখি উড়ে গেল। কাক দুটি নড়ল না। আবার ঘাড় কাত করে দেখারও চেষ্টা করল না। কী হচ্ছে।
পাখির সংখ্যা গুনতে পারলে ভালো হতো। দিন দিন পাখির সংখ্যা বাড়ে না কমে এটা দেখা যেত। একজন কাউকে কি রেখে দেবেন যার কাজ হবে দিনে তিনবার পাখি গোনা! সকালে একবার, দুপুরে একবার, সন্ধ্যায় আরেকবার।
লোকমান-সুলেমান দুই ভাইই তাঁর সঙ্গে আছে। তাদের চোখে মুখে কোনো পরিবর্তন নেই। বিশাল একটা জংলা কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা হয়েছে, সেখানে ধান ছড়ানো হচ্ছে। পাখি এসে এই ধান খাচ্ছে। এই বিষয়গুলি তাদেরকে স্পর্শ করছে না। ধান ছড়ালে পাখি খাবে— এর মধ্যে আশ্চর্যের কিছু নাই। এই দৃশ্য আয়োজন করে দেখারও কিছু নাই।
সুলেমান!
জি চাচাজি?
একটা জিনিস কি লক্ষ করেছ, পাখি যখন ধান খায় সে কোনো শব্দ করে না? ডাকাডাকি নাই, ক্যাচক্যাচানি নাই।
সুলেমান কিছু লক্ষ করে নি, তারপরেও সে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।
আমি কিছুক্ষণ একা একা জঙ্গলে হাঁটাহাঁটি করব। তোমরা দুজন বাইরে অপেক্ষা করো।
দুই ভাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। উনাকে একা রেখে তাদের ঘরে যাবার কোনো ইচ্ছা নেই। এই কথাটা বলার সাহসও পাচ্ছে না।
সিদ্দিকুর রহমান বললেন, দাঁড়িয়ে আছ কেন? যাও। কাঁটাতারের বাইরে থাকো। আমি না ডাকলে ভিতরে ঢুকবে না।
তিনি বনের ভেতরে ঢুকে গেলেন। সাপখোপের ব্যাপার এখন থাকবে না। শীতের সময় সাপ গর্তে ঢুকে এক ঘুমে সময় পার করে দেয়। একেক প্রাণীজগতের জন্যে একেক ব্যবস্থা। সব ব্যবস্থার পিছনে সূক্ষ্ম কোনো হিসাব আছে। এই হিসাব সবার বোঝার বিষয় না।
তিনি অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে হাঁটছেন। নজর করে কিছু দেখছেন না। আবার সবকিছুই দেখছেন। জঙ্গলের মাঝখানে বড়-সড় ডোবার দেখা পেলেন। ডোবায় রোদ পড়েছে। ঝিলমিল করছে ডোবার পানি। পানিও পরিষ্কার। তার কাছে মনে হলো, এত পরিষ্কার পানি তিনি অনেকদিন দেখেন নি। ডোবাটাকে আরো বড় করলে কেমন হয়? দিঘি হবে না। বিলের মতো হবে। এই ঝিল বনের ভেতর দিয়ে সাপের মতো একেবেঁকে যাবে।
তার গরম লাগছে। বনের ভ্যাপসা গরম। তিনি গায়ের পাঞ্জাবি খুললেন। হঠাৎ মনে হলো, শুধু পাঞ্জাবি কেন খুলবেন? কেন সম্পূর্ণ নগ্ন হবেন না? আব্রুর জন্যেই তো পোশাক। এখন তাঁর আব্রু ঘন বন। এই বনে দ্বিতীয় কেউ ঢুকবে না। নগ্ন হবার চিন্তাটা বাদ দিলেন। সব চিন্তাকে প্রশ্ৰয় দিতে নাই। শুধুমাত্র মস্তিষ্ক বিকৃত মানুষই সকল চিন্তাকে প্রশ্ৰয় দেয়।
তার মাথার উপর দিয়ে ট্যা ট্যা করে এক ঝাক টিয়া পাখি উড়ে গেল। তিনি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছেন। এই বনে নিশ্চয়ই প্রচুর টিয়া পাখি বাস করে। তার মনে হলো–বনের নাম টিয়া বন দিলে কেমন হয়? লীলাবতীকে একবার এনে বন দেখাতে হবে। সেটা কি আজই দেখাবেন? নাকি আরো কিছু পরে? লীলা চলে যাবার প্রস্তুতি নিয়ে নিয়েছে। যে-কোনো একদিন সে বলবে— আমি আজ দুপুরের গাড়িতে যাব। তখন তাকে যেতে দিতে হবে। পশুপাখি আটকে রাখা যায়। মানুষ আটকে রাখা যায় না।
শব্দ করে ঝোপ-ঝাড় নাড়িয়ে কোনো একটা জন্তু ছুটে গেল। বনবিড়াল হতে পারে। আবার খরগোশও হতে পারে। বনের পশু যা আছে কাঁটাতারের বেড়ায় আটকা পড়েছে। এটা মন্দ কী! এই বনে কী কী পশু আছে তার একটা হিসাব থাকলে ভালো হতো। তিনি ডোবার পানিতে নামলেন। পানি ঠাণ্ডা হবে ভেবেছিলেন। পানি ঠাণ্ডা না, যথেষ্টই গরম। পানিতে ছপছপ শব্দ তুলে হাঁটতে তার ভালো লাগছে।
লীলাবতী মঞ্জুর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। লীলাবতীর চোখে কৌতূহল, ঠোঁটের ফাকে চাপা হাসি। মঞ্জুমামার কর্মকাণ্ডে না হেসে উপায় নেই। একদল মানুষ আছে যাদের বয়স বাড়ে না। মঞ্জুমামা সেই দলের।
মঞ্জু অতি আগ্রহে পাথরে ঝিনুক ঘষছেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে কাজটা করে তিনি খুব মজা পাচ্ছেন।