হুঁ।
প্রথম শিখাবেন আলুভর্তা। এইটাই মনে হয় সবচে সোজা। সোজাটা দিয়েই শুরু হোক। ঠিক আছে?
হুঁ।
আপনার কাছে সব রান্না শিখে আমি একটা ভাতের হোটেল দিব। হোটেলের নাম দিব।— নিরঞ্জনের ভাতের হোটেল। ঠিক আছে?
হুঁ।
আপনি কি মাছ-মাংস রাঁধতে পারেন?
পারি।
কাল মাছ খাওয়াবেন। পারবেন না?
হুঁ।
কাল আমি দুজন অতিথি নিয়ে আসব। জাইতরী কইতরী। ঠিক আছে?
হুঁ।
সকালবেলা এই দুইজনকে নিয়ে চলে আসব, সন্ধ্যাবেলা যাব। নদীর পাড়ে বসে লুড়ু খেলিব। জাইতরী-কইতরী এই দুইজনকে চিনেন?
না।
সিদ্দিক সাহেবের দুই মেয়ে। এমন লক্ষ্মী মেয়ে আমি আমার জীবনে দেখি নাই। দেখব বলেও মনে হয় না। আর না দেখাই ভালো। ভালো জিনিস কম দেখতে হয়। ভালো জিনিস বেশি দেখলে ভালোর মান থাকে না।
নিরঞ্জন বলল, হুঁ।
মঞ্জু বললেন, আপনি হুঁ ছাড়া আর কিছু বলতে পারেন?
নিরঞ্জন জবাব দিল না। মঞ্জু বলল, করেন কী আপনি? এইখানে একা থাকেন?
হুঁ।
বউ ছেলেমেয়ে নাই?
আছে।
তাহলে একা থাকেন কেন?
নিরঞ্জন ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমি পতিত হইছি, আমার জাইত গেছে। আমারে সমাজ থাইক্যা বাইর কইরা দিছে। এইজন্যে একলা থাকি। বড় সােব আমারে পালে।
পতিত হয়েছেন কেন?
বড় সাহেবের জন্যে একদিন গো-মাংস রান্না করছিলাম, এইজন্যে পতিত হইছি।
বলেন কী? শুধু রান্না করার জন্যে সমাজ থেকে বের করে দিয়েছে! খেয়ে দেখেন নি!
আমি নিরামিষ ছাড়া কিছু খাই না।
মঞ্জুর মন মায়ায় ভরে গেল। আহা বেচারা। তার জন্যে কিছু করা উচিত।
জইতরী। দুপুরে খায় নি। সে খুবই মন খারাপ করেছে। কারণ মঞ্জুমামা লুড়ু খেলা নিয়ে একটা অন্যায় করেছেন। ইচ্ছা করে বাজিতে হেরে জাইতরীকে জিতিয়ে দিয়েছেন। লটারির দুটা কাগজেই জইতরীর নাম লিখেছেন। সে কাগজ দেখে টের পেয়েছে। জাইতরী এভাবে বাজি জিততে চায় নি। জাইতরী ঠিক করেছে, সে আর কোনো দিনই মঞ্জুমামার সঙ্গে কথা বলবে না। বড় পীর সাহেবের কসম— কথা বন্ধ। জাইতরী জানে সবচে কঠিন কসম— বড় পীর সাহেবের কসম। এই কসম ভাঙা মানেই মৃত্যু। কিছুক্ষণ পরই জইতরীর মনে হলো, সে একটা ভুল করে ফেলেছে। বড় ভুল। মঞ্জুমামার সঙ্গে কথা না বলে সে থাকতে পারবে না। তাকে যা করতে হবে তা হলো কসম ভাঙানোর ব্যবস্থা। একেক কসম একেকভাবে ভাঙাতে হয়। শুধু আল্লাহর নামে যে কসম সেটা ভাঙতে কিছু করতে হয় না। আল্লাহপাক কসম ভাঙলে রাগ করেন না। নাপাক অবস্থায় আল্লাহর নাম নেয়া যায়। কিন্তু বড়পীর সাহেবের নাম নেয়া যায় না।
জইতরী মন খারাপ করে ঘুরছে। পীর সাহেবের নামের কসম ভাঙানোর উপায় বের করতে পারছে না। এইসব জিনিস সবচে ভালো জানেন মা। তাকে আজ কিছু জিজ্ঞেস করা যাবে না। তার মাথা আজ অতিরিক্ত গরম। যখন তার মাথা অতিরিক্ত গরম থাকে তখন তিনি কাউকে চিনতে পারেন না। আজ জইতরী কয়েকবার তাঁর ঘরের সামনে দিয়ে গিয়েছে। তিনি জইতরীকে চিনতে পারেন নি।
এই বিষয় নিয়ে সে নতুন বউকেও জিজ্ঞেস করতে পারে। পরীবানু নামের এই মেয়েটা নিশ্চয়ই কসম ভাঙার বিষয় জানে। সমস্যা একটাই, নতুন বউয়ের সঙ্গে তার এখনো কোনো কথা হয় নি। জাইতরী আগ বাড়িয়ে কারোর সঙ্গে কথা বলে না। পরীবানুও মনে হয় তার মতো। সেও আগ বাড়িয়ে কথা বলে না। বেশির ভাগ সময় নিজের ঘরে বসে থাকে। ঘরের ভেতর হাঁটাহাঁটি করে। জাইতরী দেখেছে। হাঁটাহাঁটির সময় এই মেয়ে নিজের মনে কথা বলে। বিড়বিড় করে কথা। জইতরীর সঙ্গে এখানেও তার মিল আছে। জাইতরীও নিজের মনে কথা বলে।
পরীবানু খাটে পা বুলিয়ে বসে ছিল। তার ঘরের দরজা খোলা। খোলা দরজা দিয়ে রোদ এসে পড়েছে পরীবানুর গায়ে। অন্ধকার ঘরে পরীবানুর গায়ে রোদ পড়ার কারণে ঝলমল করছে। বারান্দা থেকে এই দৃশ্য দেখে জইতরীর এতই ভালো লাগল যে সে ঘরে ঢুকে পড়ল। পরীবানু বলল, জাইতরী কিছু বলবে?
জইতরী বলল, না।
পরীবানু বলল, তোমার সঙ্গে আমার আলাপ পরিচয় হয় নাই। মন এত খারাপ থাকে, কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করে না। তুমি মনে কিছু নিও না। আসো আমার পাশে বসে। দুইজনে কিছুক্ষণ গল্প করি।
জইতরী খাটে উঠে বসল। পরীবানু বলল, তোমার মতো সুন্দরী মেয়ে আমি আমার জীবনে দেখি নাই। তুমি যখন শাড়ি পরা ধরবে তখন তোমাকে নিয়া আমি একটা গীত বাধব।
জইতরী বলল, তুমি গীত বাধতে জানো?
পরীবানু ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, জানি। গীত বাধতে জানি, গাইতেও জানি। সবেরে অবশ্যি মিথ্যা কইরা বলি আমি কিছু জানি না।
মিথ্যা বলো কেন?
নিজেকে আড়ার রাখার জন্যে মিথ্যা বলি। মেয়েছেলেদের নিজেদের আড়াল করার জন্যে অনেক কিছু করতে হয়। তুমি নিজেও করো। করো না?
জইতরী হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। পরীবানুকে তার সামান্য পছন্দ হতে শুরু করেছে। জাইতরী বলল, আমি বড় পীর সাহেবের নামে কসম কাটছি! এখন কসম ভাঙব। আমার কী করা লাগবে তুমি জানো?
জানি।
জানলে বলে।
বড়পীর সাহেবের উপরে যিনি তাঁর নামে কসম ভাঙতে হবে। বড়পীর সাহেবের উপরে আছেন আমাদের নবী-এ করিম। তার নামে কসম ভাঙবা। কী নিয়া কসম কাটছিলা?
জইতরী কসমের ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করল। ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লক্ষ করল, কথা বলতে তার ভালো লাগছে। শুধু যে ভালো লাগছে তা না, যতই কথা বলছে পরীবানু মেয়েটাকে তার ততই ভালো লাগছে। পরীবানু বলল, তুমি কি মঞ্জু নামের মানুষটারে খুব ভালো পাও?