ভোগী মানুষ বলতে যা বোঝায় তিনি তাও না। শহরবাড়ি নামের সুন্দর বাংলো বাড়ি ছেড়ে তিনি বাস করেন মূল বাড়িতে। মূল বাড়ির দক্ষিণ-পশ্চিম দুই দিকেই ঘন জঙ্গল। হাওয়া একেবারেই আসে না। গরমের সময় কষ্ট হয়। তালের পাখা পানিতে ভিজিয়ে বাতাস করতে হয়। গরমের সময় হাওয়া করার জন্যে তার নিজস্ব একজন লোক আছে। তার নাম বন্দু। সে সারারাত একতালে পাখা করে যেতে পারে। তিনি বন্দুকে অত্যন্ত স্নেহ করেন। উত্তরবন্দে বন্দুকে তিনি দুই বিঘা ধানী জমি দিয়েছেন। মুখে-মুখে দেয়া না— দলিলপত্র করে দেয়া। দাতা হিসেবে তার কোনো সুনাম নেই। বিত্তবান মানুষরা এক পর্যায়ে স্কুল দেয়, মাদ্রাসা দেয়, নতুন মসজিদ বানায়। সিদ্দিকুর রহমান সেদিকে যান নি— তবে তিনি তাঁর নিজের খুব কাছের মানুষদের জন্যে অনেক করেছেন। লোকমান এবং সুলেমান এই দুই ভাইকেও এক বিঘা করে জমি দিয়েছেন। ঘর তুলে দিয়েছেন। এই দুই ভাই তাঁর পাহারাদার। এরা সারারাত বাড়ির উঠানে বসে থাকে। লোকমানের হাতে থাকে টোটাভরা দোনলা বন্দুক। সুলেমানের হাতে অলঙ্গা। তালকাঠ দিয়ে বানানো বর্শাজাতীয় অস্ত্ৰ। অলঙ্গাচালনায় সুলেমান অত্যন্ত পারদর্শী।
অতি বিত্তবান মানুষদের শত্রু থাকবেই। তারও আছে। উপগ্রহের মতো তারা তাকে ঘিরে পাক খায়। তাকে সাবধান থাকতে হয়। দিনের বেলা একা ঘুরে বেড়ালেও রাতে তা করা যায় না। লোকমান এবং সুলেমানকে সঙ্গে রাখতে হয়। তিনি সাবধান থাকেন।
রেললাইনের স্লিপারে পা দিয়ে অতি দ্রুত কে যেন আসছে। কুয়াশার কারণে লোকটাকে দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু তার হাঁটার ভঙ্গিতেই সিদ্দিকুর রহমান তাকে চিনলেন–লোকমান। তার খোজে আসছে। লোকমান জানে চেয়ারম্যান সাহেবের রেললাইনের পাশ ধরে হাঁটার অভ্যাস আছে। প্রথমে সে খোঁজ নিতে এসেছে রেল সড়কে।
তিনি গলা-খাকারি দিলেন। এতদূর থেকে গলা-খাকারির শব্দ শুনতে পারার কথা না। কিন্তু লোকমান ঠিকই শুনল। থমকে দাঁড়িয়ে গেল এবং মাথা সামান্য নিচু করে দ্রুত তার দিকে আসতে শুরু করল। সিদ্দিকুর রহমান এক ধরনের তৃপ্তি বোধ করলেন। অর্থ-বিত্তের মতো লোকমানও এক ধরনের সম্পদ। এই সম্পদের গুরুত্বও কম না।
কোনো খবর আছে লোকমান?
জি-না।
মাগরেবের ওয়াক্ত কি হয়েছে? লোকমান চাঁদরের ভেতর থেকে হাত বের করে হাতের দিকে তাকিয়ে থাকল। যদি হাতের পশম না দেখা যায় তাহলে সূর্য ড়ুবে গেছে। মাগরেবের নামাজের ওয়াক্ত হয়েছে। সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিম আকাশ লাল থাকতে থাকতে নামাজটা পড়ে ফেলতে হয়।
লোকমান বলল, জি, নামাজের ওয়াক্ত হয়েছে।
নামাজের ব্যবস্থা করো। নামাজ পড়ে তারপর যাব। ওজুর পানি লাগবে না। ওজু আছে।
লোকমান অতি দ্রুত গাছের শুকনা পাতা সরিয়ে নিজের গায়ের চাঁদর পেতে দিল। গায়ের চাঁদর সরানোয় লোকমানের কাধে রাখা বন্দুক দেখা যাচ্ছে। সে বন্দুক মাঠে শুইয়ে রেখে ঝিম ধরার মতো করে বসে আছে। বন্দুকের মাথা পূর্বদিক করে রাখা। বন্দুকের মাথা কখনো পশ্চিম দিক করে রাখতে নাই।
সিদ্দিকুর রহমান নামাজ শেষ করলেন। অন্যদিনের চেয়ে অনেক বেশি। সময় নিয়ে নামাজ পড়লেন। নামাজের শেষে দোয়া করলেন। অদ্ভুত দোয়া। তিনি বললেন, হে রহমানুর রহিম, তুমি রমিলার প্রতি তোমার রহমত প্ৰকাশ করো। তুমি তার মৃত্যু দাও। আমি তোমার পাক দরবারে তোমার বান্দার মৃত্যু কামনা করছি। এই অন্যায় দোয়ার জন্যে তুমি আমাকে ক্ষমা করো, ক্ষমা করো দয়াময়।
চারদিক অন্ধকার হয়ে গেছে। বনের ভেতরে শিয়াল ডাকতে শুরু করেছে। গতবছর শিয়ালের ডাক প্রায় শোনেনই নি। এই বছর শিয়ালের উপদ্রব বেড়েছে। সমানে হাঁস-মুরগি খাচ্ছে। এত শিয়াল কোথেকে এসেছে কে জানে? বন্য পশুপাখি কখনো এক জায়গায় থাকে না। তারা জায়গা বদল করে। মানুষও তো এক অর্থে পশু। তার ভেতরেও জায়গা বদলের প্রবণতা আছে। কিন্তু সে জায়গা বদলায় না। সে চেষ্টা করে শিকড় গেড়ে বসতে। বাড়ি-ঘর বানায়। গাছপালা লাগায়। এমন ভাব করে যেন সে থিতু হয়েছে। অথচ সে কখনো থিতু হয় না। সে সবসময়ই জায়গা বদলের অস্থিরতা নিয়ে বাস করে।
সিদ্দিকুর রহমান চাঁদর থেকে নামলেন। চাপা গলায় ডাকলেন, লোকমান!
লোকমান ছুটে এলো।
সাথে টর্চ আছে?
জি আছে।
চলো রওনা দেই।
জি আচ্ছা।
না গিয়ে রেললাইন ধরে হাঁটি। উত্তরদিকে যাই।
জি আচ্ছা।
সিদ্দিকুর রহমান বকটা যো-জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল ঠিক সেখানে উপস্থিত হলেন। লোকমান কোনো কথা না বলে তার পেছনে পেছনে আসছে। একে বলে আনুগত্য। এ-ধরনের আনুগত্য আজকাল পাওয়া যায় না। তার ভাগ্য ভালো তিনি পেয়েছেন। তিনি যা করতে বলবেন লোকমান তা-ই করবে। কোনো প্রশ্ন করবে না। আচ্ছা, তিনি যদি লোকমানকে বলেন–লোকমান, তুমি রেললাইনের উপর বসে থাকে। আমি না বলা পর্যন্ত নড়বে না। ট্রেন গায়ের উপর এসে পড়লেও নড়বে না। তাহলে সে কি শুনবে?
লোকমান!
জি?
পান খেতে ইচ্ছা করছে। পানের বাটা নিয়ে আসো। আর সবাইকে বলে আসো, আমার ফিরতে সামান্য দেরি হবে।
একলা থাকবেন?
হ্যাঁ, একাই থাকব। কোনো অসুবিধা নাই। টর্চটা আমার কাছে দিয়ে যাও। শোনো লোকমান, আমি হাঁটা ধরছি। উত্তর দিকে যাব। তুমি তাড়াতাড়ি এসে আমাকে ধরে।
কথা শেষ করার আগেই লোকমান প্ৰাণপণে দৌড়াতে শুরু করেছে। সিদ্দিকুর রহমান জানেন তিনি বেশিদূর যেতে পারবেন না, তার আগেই লোকমান উপস্থিত হবে। লোকমান একা আসবে না, সঙ্গে সুলেমানকে নিয়ে আসবে। তারা দুই ভাই তাঁর পেছনে পেছনে এগোতে থাকবে। এরা দুইজন যেন তার ছায়া। মানুষের একটা ছায়া পড়ে, তাঁর পড়ে দুই ছায়া।