ও নাতবউ শোনো, ঘোড়ার চেট দেখছো? দেখো নাই? না দেখলে গফ যেটা করতেছি। এইটা বুঝবা না। সিদ্দিকরে বলো মর্দ ঘোড়া একটা আনতে। ঘোড়ার পুটকিতে ঝাড়ু দিয়া খোঁচা দিলে ছলাৎ কইরা বাইর হয়। একটা দেখনের মতো জিনিস। হি হি হি হি।
মৃত্যুর তিন মাস আগে ফুলবানুর জবান বন্ধ হয়ে গেল। তিনি ঠোট নাড়েন, জিভ নাড়েন – কোনো শব্দ বের হয় না। এই সময় তাঁর শরীর থেকে তীব্ৰ পচা গন্ধ বের হতে শুরু করল। সিদ্দিকুর রহমান বসতবাড়ি থেকে অনেক দূরে পুকুরপাড়ে তড়িঘড়ি করে ছনের ঘর তুলে তাঁর দাদিজানকে সেখানে পাঠিয়ে দিলেন। সেবা করার জন্যে রমিলা সঙ্গে গেল। জুম্মাঘরের মওলানা সাহেবকে এনে ফুলবানুর মৃত্যু প্রার্থনা করে বিশেষ দোয়ার ব্যবস্থা হলো। এক লক্ষ দশ হাজার বার দুরুদে শেফা পাঠ করা হলো। তার পরেও মৃত্যু আসে না।
রাত একটু বাড়লেই পুকুরপাড়ের ছনের ঘরের চারপাশে শিয়াল হাঁটাহাঁটি করে। রমিলা ঘরের ভেতরও মানুষজনের হাঁটাহাঁটির শব্দ পায়। তাদের ফিসফাস কথা শানে। এরা এই জগতের মানুষ না–বিদেহী আত্মা। হয়তো ফুলবানুর মৃত পিতামাতা। তাদের সন্তানকে দেখতে এসেছে। ভয়ে রমিলার হাত-পা কাপে। রমিলা ভয় প্রকাশ করে না। খাটের চার মাথায় চারটা হারিকেন জ্বলিয়ে আয়াতুল কুরসি পড়ে রাত কাটায়। মাঝে মাঝে তার কাছে মনে হয়, কে যেন পেছন থেকে তার ঘাড়ে হিমশীতল নিঃশ্বাস ছাড়ে। সে পেছন ফিরে তাকায় না। মাথা আরো নিচু করে কোরানশরিফের পাতা উল্টায়। পেছনে তাকালে সত্যি সত্যি যদি কিছু দেখা যায়! কী দরকার?
এক শ্রাবণ মাসের মধ্যরাতে রমিলার মুক্তি ঘটল। ফুলবানু হঠাৎ গোঙানি ধরনের শব্দ করে নিথর হয়ে গেলেন। রমিলা নিঃশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল। ফুলবানুর ঘরের দরজা ভালোমতো বন্ধ করে পুকুরপাড়ে চলে গেল। গায়ে সাবান ডলে মনের আনন্দে সাতার কেটে পুকুরে গোসল করল। ভেতর বাড়িতে ফিরে এসে ভেজা কাপড় বদলে পাটভাঙা নতুন একটা শাড়ি পরল। চুল বঁধিল। চোখে কাজল দিল। সূর্য ডোবার পর আয়নায় নিজেকে দেখা নিষেধ, তার পরেও অনেকক্ষণ আয়নায় নিজেকে দেখে সিদ্দিকুর রহমানের শোবার ঘরের বন্ধ দরজার কড়া নাড়ল। সিদ্দিকুর রহমান ভীত গলায় বললেন, কে? কে?
রমিলা শান্ত গলায় বলল, আমি। খারাপ সংবাদ আছে। আপনার দাদিজান মারা গেছেন।
কী সর্বনাশ! বলো কী! কখন?
এই তো কিছুক্ষণ। দরজা খোলেন।
তিনি দরজা খুলে স্ত্রীকে দেখে খুবই অবাক হলেন। মরা-বাড়িতে সে এত সাজপোজ করেছে কেন? তার কি মাথায় গোলমাল হয়েছে! যে-যন্ত্রণা তার উপর দিয়ে গিয়েছে মাথায় গোলমাল হবারই কথা।
রমিলা বলল, আপনি যান। মুনশি-মওলানা খবর দেন, আত্মীয়স্বজন খবর দেন। আমি কিছুক্ষণ শান্তিমতো ঘুমাব। অনেকদিন আমি শান্তিমতো ঘুমাইতে পারি না। কেউ যেন আমারে না ডাকে।
মরার সময় দাদিজান কি কিছু বলেছেন? অনেক সময় মৃত্যুর আগে-আগে জবানবন্ধ মানুষের জবান খুলে যায়। কথা বলে। দাদিজান কিছু বলেছেন?
হ্যাঁ, বলেছেন। তিনি বলেছেন আপনি যেন আপনার প্রথম স্ত্রীর সন্তানটাকে এই বাড়িতে নিয়ে আসেন। নিজের সন্তান অন্যখানে মানুষ হবে এইটা কেমন কথা?
সত্যি বলেছেন?
রমিলা ছোট করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, না, দাদিজান কিছু বলেন নাই। মৃত্যুর সময় তার জবান খুলে নাই। এইটা আমার নিজের কথা। আপনার প্রথম স্ত্রীর ঘরে যে মেয়েটা আছে সে এখন কত বড়?
অনেক বড় হয়েছে। দশ-এগার বছর। সে আসবে না। আগেও কয়েকবার চেষ্টা করেছি। তার মামারা দেয় না। সেও আসতে চায় না।
আবার চেষ্টা করেন। চেষ্টা করতে তো দোষ নাই। মেয়েটার নাম কী?
ভালো নাম লীলাবতী। সবাই লীলা বলে ডাকে।
বাহ, সুন্দর নাম– লীলা! তারা যদি দুই ভইন থাকত। তাইলে পরের ভইনের নাম হইত খেলা। দুই ভইনের একত্রে নাম— লীলা-খেলা।
বলতে বলতে রমিলা হেসে ফেলল। শব্দ করে হাসি। হাসির দমকে তার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল। একসময় সে হাসি সামলাবার জন্যে মুখে আঁচলাচাপা দিয়ে মেঝেতে বসে পড়ল। মাথার ঘোমটা খুলে শাড়ির আঁচল চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল।
সিদ্দিকুর রহমান অবাক হয়ে বললেন, কী ব্যাপার, হাসে। কেন?
রমিলা বলল, জানি না কেন হাসি।
হাসি থামাও।
থামাইতে পারতেছি না।
সে হাসতেই থাকল।
রমিলার মাথা-খারাপের লক্ষণ সেদিনই প্রথম প্রকাশ পেল।
সন্ধ্যা নেমে গেছে। সিদ্দিকুর রহমান আগের জায়গাতেই বসে আছেন। এখনো শীত নামার কথা না, কিন্তু শীত-শীত লাগছে। সারা শরীরে আরামদায়ক আলস্য। একটা কলা থাকলে কম্বল বিছিয়ে শুয়ে থাকা যেত। সেটা মন্দ হতো। না। গায়ের উপর হিম পড়ত। শীতের প্রথম হিমের অনেক গুণাগুণ আছে। আয়ুৰ্বেদিক কিছু ওষুধে প্রথম শীতের শিশিরের ব্যবহার আছে।
তিনি উঠে বসলেন। দীর্ঘ ঘুমের পরে শরীরে ভোতা ভাব চলে আসে, সেই ভাবটা আছে। হাত-পা ভারি-ভারি লাগছে। বাড়ির দিকে রওনা হতে ইচ্ছা! করছে না। বরং ইচ্ছা করছে রেললাইনের স্লিপারে পা দিয়ে হাটা শুরু করতে। তিনি একজন সুখী এবং পরিতৃপ্ত মানুষ। সুখী মানুষদের মধ্যেই হঠাৎ বৈরাগ্য দেখা দেয়। অসুখী মানুষরা সাধু-সন্ন্যাসী হয় না। তৃপ্ত পরিপূর্ণ মানুষরাই হয়। বৈষয়িক দিক দিয়ে তিনি সফল মানুষ না। বাড়ি-ঘর, দিঘি জলমহালের তাঁর যে বিশাল সাম্রাজ্য সেটাও পূর্বপুরুষের করে যাওয়া। তিনি পূর্বপুরুষের সম্পদ রক্ষা করে যাচ্ছেন। এর বেশি কিছু না।