তোমাকে পড়তে বলেছে তুমি পড়বে। উনি শুনতে পান কি পান না সেটা উনার ব্যাপার।
উনার কোনো কথা আমি শুনব না।
কেন শুনবে না?
উনি আমার সাথে অশ্লীল কথা বলেন।
কী অশ্লীল কথা?
সেটা আমি বলতে পারব না। আমি মুখে আনতে পারব না।
গ্ৰামদেশের বৃদ্ধারা নাতবউয়ের সঙ্গে অশ্লীল কথা বলে। এতে দোষ হয় না।
দোষ-গুণের কথা না। আমার ভালো লাগে না।
তোমার ভালো লাগা দিয়ে তো দুনিয়া চলবে না।
না চললে না।
সিদ্দিকুর রহমান দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তুমি দুষ্ট প্রকৃতির মেয়ে।
আয়না সঙ্গে সঙ্গে বলল, আমি দুষ্ট প্রকৃতির মেয়ে না। আপনার দাদি দুষ্ট প্রকৃতির। আপনিও দুষ্ট প্রকৃতির। দুষ্ট দাদির নাতি দুষ্ট হয়।
সিদ্দিকুর রহমান বিরক্ত গলায় বললেন, আমার সম্পর্কে যা ইচ্ছা বলো কোনো ক্ষতি নাই। কিন্তু আমার দাদি সম্পর্কে এই ধরনের কথা আর কোনোদিন বলবে না। শৈশবে আমার মা-বাবা মারা গিয়েছিলেন। আমাকে মানুষ করেছেন। আমার দাদিজান। এটা মাথায় রাখবা।
আয়না শান্ত গলায় বলেছে, এটা আপনি মাথায় রাখেন। উনি আপনাকে মানুষ করেছেন। আমাকে করেন নাই। আমি উনাকে দুষ্ট মহিলা বলব।
এই পর্যায়ে সিদ্দিকুর রহমান রাগ সামলাতে পারেন নি। আয়নার গালে চড় বসিয়ে দিলেন। আয়না ব্যাপারটার জন্যে প্রস্তুত ছিল না। সে খাটের এক কোনায় বসেছিল— খাট থেকে হুড়মুড় করে নিচে পড়ে গেল। সিদ্দিকুর রহমান তুলতে গেলেন। তার আগেই আয়না উঠে পড়ল। শান্ত ভঙ্গিতে খাটের যে জায়গায় আগে বসেছিল সেই জায়গায় বসল। যেন কিছুই হয় নি এমন ভঙ্গিতে বলল, আপনার দাদিজান আমার শরীর শুকে বলেছেন–আমার শরীরে পরপুরুষের গন্ধ আছে। আপনার গায়ের গন্ধ উনি চিনেন। আপনার গায়ের গন্ধ না-কি আমার শরীরে নাই। প্রথম যে-পুরুষের সঙ্গে মেয়ে শোয় সেই পুরুষের গন্ধ গায়ে লেগে যায়। আমি না-কি বিয়ের আগে অন্য পুরুষের সঙ্গে শুয়েছি। সেই পুরুষের টক-টক গন্ধ আমার গায়ে আছে। যে মহিলা এমন কথা বলেন তাকে আমি দুষ্ট মহিলা বলব।
সিদ্দিকুর রহমান কী বলবেন ভেবে পেলেন না। তার মাথা ঝিমঝিম করছে। স্ত্রীর গালে চড় মারার ব্যাপারটায় তিনি নিজেও হ’কচাকিয়ে গেছেন। এখন আয়না। কী বলছে সেটা তার মাথায় ঢুকছে না। তার উচিত এখনি স্ত্রীর কাছে ক্ষমা চাওয়া। কীভাবে চাইবেন তাও বুঝতে পারছেন না।
আয়না বলল, আমি কাল সকালে বাপের বাড়ি চলে যাব। আমাকে পাঠাবার ব্যবস্থা করবেন। যদি না করেন তাহলে আমি নিজেই চলে যাব। যতদিন আপনার দাদি জীবিত থাকবেন ততদিন আমি আসব না। উনার মৃত্যু-সংবাদ পাওয়ার পর আসব।
এটা কেমন কথা?
কেমন কথা আমি জানি না। আপনার সঙ্গে আমার আর কোনো কথাই নাই। কাল সকালে আমাকে বাপের দেশে পাঠাবেন।
মুখে বললে তো হয় না, আয়োজন করতে হবে। সঙ্গে লোক দিতে হবে। একা তোমাকে কোনোদিনই ছাড়ব না।
লোক জোগাড় করেন। যতদিন না লোক জোগাড় হয়েছে ততদিন আমি এই বাড়ির কিছু খাব না। পানিও না।
তুমি বাড়াবাড়ি করছি।
মানুষমাত্রই অল্পবিস্তর বাড়াবাড়ি করে। আপনিও করেন। আমিও করি। আপনি চড় দিয়ে বাড়াবাড়ি করেছেন, আমিও খাওয়া বন্ধ করে বাড়াবাড়ি করব।
এই বলেই খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে আয়না শুয়ে পড়ল। সিদ্দিকুর রহমান অবাক হয়ে লক্ষ করলেন, আয়না ঘুমিয়ে পড়েছে।
আয়না সত্যি সত্যি খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিল। সিদ্দিকুর রহমান নানানভাবে চেষ্টা করলেন, কোনো লাভ হলো না। তার পরের দিন দুপুরে নান্দাইল রোড স্টেশনে তিনি স্ত্রীকে তুলে দিতে গেলেন। ট্রেনের কামরায় ওঠার পর আয়না এক চুমুক পানি খেয়ে তার অনশন ভঙ্গ করল।
ফুলবানু ঘোষণা করলেন, আয়নাকে ফিরিয়া আনার কোনো চেষ্টা করলে তিনি সবার সামনে গুড়ের শরবতে ইদুর-মারা বিষ গুলো খাবেন। যদি না খান তাহলে তিনি সতী মায়ের সতী কন্যা না। বাজারের বেবুশ্যা। তিনি শুধু যে একা বেবুশ্যা ৩া না, তার মাও বেবুশ্যা। তার পরেও সিদ্দিকুর রহমান আয়নাকে ফিরিয়ে আনার অনেক চেষ্টা করেছেন। নিজে গিয়েছেন। কয়েকবার। লোক পাঠিয়েছেন। আয়না রাজি হয় নি। তার এক কথা— যতদিন বুড়ি বেঁচে থাকবে ততদিন আমি যাব না। বুড়ি যেদিন মারা যাবে তার পরদিন আমি উপস্থিত হব।
আয়না পরের বছরই সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেল। ফুলবানু আরো এগার বছর বেঁচে রইলেন। শেষের দিকে ফুলবানু চোখে দেখতে পেতেন না। একেবারেই কানে শুনতে পেতেন না। হাঁটাচলার শক্তি নেই। ঘা হয়ে শরীর পচে গেল। চিত-কাত করে শোয়াতে গেলে হাত দিয়ে তাকে ধরা যায় না। কচি কলাপাতা গায়ের উপর দিয়ে ধরতে হয়। সেই কলাপাতাও গায়ে লেগে যায়। পাতা টেনে তোলার সময় তিনি ব্যথায় চিৎকার করেন। এমন অবস্থাতেও মৃত্যুকে পাশ কাটিয়ে কথা বলার শক্তি এবং প্রবল ঘ্ৰাণশক্তি নিয়ে তিনি বেঁচে রইলেন।
বয়সের সঙ্গে এই দু’টি শক্তি বেড়েছে। বাড়ির সীমানার ভেতর কেউ ঢুকলেই তিনি গন্ধ শুকে শুকে বলে দেন কে ঢুকেছে।
পাকনা বড়ই খাইয়া কে ঘরে ঢুকছে? কে ঢুকছে? লাটসাবের নাতি হও আর যে-ই হও মুখ ধুইয়া আয়। চুকা গন্ধ আসন্তাছে। চুকা গন্ধে বয় (বমি) আসন্তাছে। যে আসছে সে তো পিসাব কইরা পানি নেয় নাই। আমি পিসাবের গন্ধও পাইতেছি।
ততদিনে সিদ্দিকুর রহমান দ্বিতীয় বিবাহ করেছেন। স্ত্রীর নাম মোসাম্মত রমিলা খাতুন। থালার মতো গোলাকার মুখ। রুগ্ন শরীর কিন্তু কাজ করার অস্বাভাবিক ক্ষমতা। রমিলার উপর ভার পড়ল ফুলবানুর সেবা-শুশ্রুষার। রমিলা খুবই দক্ষতার সঙ্গে তাঁর দাদিশাশুড়ির সেবা করতে শুরু করল। ফুলবানুর রমিলাকে পছন্দ হলো। সারারাত ফুলবানুর ঘুম হয় না। গল্প করার জন্যে রমিলাকে ডেকে আনেন। গলা নিচু করে জগতের অশ্লীলতম গল্প করতে থাকেন। বিকারগ্রস্ত মানুষের প্রলাপ। রমিলাকে মাথা নিচু করে শুনতে হয়। একটু পরে পরে ‘হুঁ’ বলতে হয়।