ধুলাবালির উপর বসে থাকার কোনো অর্থ হয় না। কিন্তু তাঁর উঠতেও ইচ্ছা! করছে না। বরং আবারো শুয়ে পড়তে ইচ্ছা করছে। সন্ধ্যা না মিলানো পর্যন্ত শুয়ে থাকলে মন্দ হয় না। সন্ধ্যা মিলাবে। ঘন হয়ে কুয়াশা পড়বে। আজ চাঁদের নয় তারিখ, চাঁদের আলো আছে। সেই আলো কুয়াশায় পড়বে। কুয়াশাকে মনে হবে চাঁদের আলোর হাওর। সেই হাওরের ভেতর দিয়ে বাড়িতে পৌছে যাওয়া। খোলা মাঠে চিত হয়ে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নানান বিষয়ে চিন্তা করতে খারাপ লাগার কথা না। তাঁর বয়স সাতান্ন। এই বয়সে মানুষ পার করে আসা জীবনের কথা চিন্তা করে। সূক্ষ্ম হিসাব-নিকাশ করে। কোনো হিসাবই মেলে না। এই বয়সটা হিসাব মেলানোর জন্যে ভালো না।
সিদ্দিকুর রহমান চারদিক দেখে নিয়ে আবারো শুয়ে পড়লেন। পাঞ্জাবিতে ধুলা যা লাগার লেগে গেছে। বাড়িতে পৌছে গরম পানি দিয়ে গোসল দিতে হবে। বড় এক বালতি গরম পানিতে সামান্য কিছু কপূরদানা ছেড়ে দিয়ে আরাম করে গোসল। পানিতে কপূর দিয়ে গোসলের অভ্যাস তিনি পেয়েছেন তাঁর প্রথম স্ত্রী আয়নার কাছ থেকে। কপূর দিয়ে গোসলের জন্যে আয়নার শরীরে কপূরের গন্ধ লেগে থাকত। কাপড়ে কপূরের গন্ধ লাগলে কাপড় বাসিবাসি মনে হয়। মানুষের গায়ে এই গন্ধ আবার অন্যরকম লাগে। আয়না। কতদিন আগে চলে গেছে, কিন্তু তার অভ্যাস রেখে গেছে। মানুষ কখনো পুরোপুরি চলে যায় না। কিছু-না-কিছু সে রেখে যায়।
তিনি আয়নার চেহারা মনে করার চেষ্টা করলেন। চট করে চেহারা চোখে ভেসে উঠল। এটাও একটা আশ্চর্য হবার মতো ঘটনা। আগে অনেকবার চেষ্টা করেছেন, চেহারা মনে করতে পারেন নি। লম্বা মুখ, সরু কপাল, বড় বড় চোখ। চোখের রঙ বাদামি। একটা কিশোরী মেয়েকে শাড়ি পরিয়ে বড় করার চেষ্টা করলে যেমন দেখায় তাকে সেরকম দেখাচ্ছে। সে তরুণীও না, কিশোরীও না। দুয়ের মাঝামাঝি থেকেই আয়না তার ক্ষুদ্র জীবন শেষ করে গেল। আফসোসের ব্যাপার। খুবই আফসোসের ব্যাপার।
নবপরিণীতা স্ত্রীকে নিয়ে তিনি যখন প্রথম বাড়িতে ঢোকেন তখন তাঁর দাদিজান ফুলবানু জীবিত। বুড়ির বয়স সত্ত্বরের উপরে। মেরুদণ্ড বেঁকে গেলেও শক্তসমর্থ শরীর। কানে শুনতে পান না। কিন্তু চোখে খুব ভালো দেখেন। নতুন বউকে দেখে ফুলবানু বিরক্ত মুখে বললেন–শুনছি বউ হেন, বউ তেন। কই গায়ের রঙ তো ময়লা! ভালো ময়লা। তিন রাইজ্য খুঁইজ্যা কী বউ আনল?
সিদ্দিকুর রহমানের এক ফুপু বললেন, আম্মা। আপনি কী বলেন? কী সুন্দর চাপা রঙ!
ফুলবানু বললেন, হাতের আর মুখের চামড়ার রঙ কোনো রঙ না। পেটের চামড়ার রঙ আসল। পেটের চামড়া দেখছো? ও নতুন বউ, শাড়ির আঁচলটা টান দিয়া পেট দেখাও।
নতুন বউ দাদিজানের কথা শুনে কেঁদে কেটে অস্থির।
রাতে সিদ্দিকুর রহমান স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন, দাদিজানের কথায় তুমি কিছু মনে করবে না। দাদিজান এরকমই। আয়না ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলেছিল, কেউ আমাকে কোনোদিন কালো বলে নাই।
কেউ বলে নাই, এখন একজন বলেছে। তাতে কী?
তাতে অনেক কিছু।
সিদ্দিকুর রহমান শান্ত গলায় বললেন, গায়ের রঙ কিছু না বউ। মনের রঙ আসল রঙ। মনের রঙ কালো না হলেই হয়।
নতুন বউ তাকে অবাক করে দিয়ে বলল, এটা তো ভুল কথা। আমার গায়ের রঙ কালো হলে আপনি কি আমাকে বিবাহ করতেন? আপনারা প্রথম খুঁজেছেন রঙ। আপনারা সম্বন্ধ করতে গিয়ে কোনো মেয়ের মনের রঙ কী সেই খোঁজ নেন নাই। মনের রঙ দেখা যায় না। গায়ের রঙ দেখা যায়। আমি কি ভুল বলেছি?
সিদ্দিকুর রহমান জবাব দেন নি, তবে স্ত্রীর উপর সামান্য বিরক্ত হয়েছেন। নতুন বউ মুখের উপর কটকট করে এত কথা বলবে কেন? বাসররাতে স্বামী কথা বলবে, স্ত্রী লম্বা ঘোমটা টেনে বসে থাকবে। মাঝে মাঝে হ্যা-নাসূচক মাথা নাড়বে। এটাই চিরকালের নিয়ম।
নতুন বউয়ের মুখের উপর কথা বলার এই স্বভাব অল্পদিনেই স্পষ্ট হয়ে উঠল। এই মেয়ে মুখ বন্ধ রাখে না। কেউ কিছু বললে সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয়। ফুলবানু নাতবউয়ের উপর খুবই বিরক্ত হলেন। তিনি তার নাম দিলেন—কটর কটর পক্ষী। বাড়িতে কেউ এলেই ফুলবানু আয়োজন করে নতুন বউয়ের নতুন নাম শুনিয়ে তার দোষ-ত্রুটি নিয়ে গল্প করতে বসেন–ভাটি অঞ্চলের মেয়ে। পানির মধ্যে বড় হইছে। পাইন্যা স্বভাব হইছে। পাইন্যা স্বভাব কী বুঝলা না? পানি কী করে? গড়াইয়া চলে। নয়া বউ গড়াইয়া চলে। সবসময় গড়াইতেছে। মেয়ের কেমন বাপ-মা কে জানে! কোরান মজিদ পাঠ করতে শিখে নাই। নাতবাউরে সেদিন বললাম— কোরান মজিদ পাঠ কইরা শুনাও। সুরা ইয়াসিন পাঠ করো। নাতবউ বলল, সে কোরান মজিদ পড়তে শিখে নাই। তোমরা কেউ এমন কথা কোনোদিন শুনছো— মেয়েরে কোরান মজিদ পাঠ করতে না শিখাইয়াই মেয়ে বিবাহ দিয়েছে? ছিছিছি! ঝাড়ু মারি এমন বাবা-মা’র মুখে। এরা শিয়াল কুত্তার অধম।
আয়না কোরান মজিদ পাঠ করতে পারে না। শুনে সিদ্দিকুর রহমানও বেশ বিরক্ত হয়েছিলেন। তিনি মনের বিরক্তি চেপে রেখে বলেছিলেন— কোরান মজিদ পাঠ করতে পারাটা খুবই প্রয়োজন। তুমি শিখে নাও। জুম্মাঘরের মওলানা সাহেবরে বলব। তুমি বোরকা পরে তাঁর কাছে সবক নিবা। আয়না। তাকে বিস্মিত করে বলেছিল, কোরান মজিদ তো আমি পড়তে পারি।
পড়তে পারো তাহলে দাদিজানের কাছে মিথ্যা বললে কেন?
উনি কানে শোনেন না। উনি কোরান মজিদ পাঠ কী শুনবেন?