মঞ্জুমামা লীলার আপন মামা না। লীলার মায়ের খালাতো ভাই। নয়াপুরে তার একটা ফার্মেসি, একটা টি স্টল এবং রেডিও সারাই-এর দোকান আছে। কোনো দোকান থেকেই তেমন কিছু আসে না। এই নিয়ে তার মাথাব্যথাও নেই। ব্যবসা পাতির খোঁজখবর নিতে গেলে তার টেনশন হয় বলেই তিনি কোনো খোঁজখবর করেন না। দিনের বেশিরভাগ সময় তার স্কুলজীবনের বন্ধু পরেশের চায়ের দোকানে বসে থাকেন। দোকানের পেছনে চৌকির উপর শীতল পাটি পাতা থাকে। ঘুম পেলে সেখানে ঘুমিয়ে পড়েন। মগুমামার বয়স পয়তাল্লিশ। এখনো বিয়ে করেন নি, তবে বিয়ের কথা চলছে। পত্রিী নয়াপাড়া প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা। মাঘ মাসের ছয় তারিখে বিয়ের কথা পাকা হয়ে আছে। তার পরও স্থানীয় মানুষজনের ধারণা, এই বিয়ে শেষ পর্যন্ত হবে না। আগেও কয়েকবার বিয়ের কথাবার্তা পাকা হয়েছে, শেষ পর্যন্ত বিয়ে হয় নি। মঞ্জুমামাকে লীলা নিয়ে এসেছে তার চড়নদার হিসেবে। সম্পূর্ণ নতুন একটা জায়গায় যাচ্ছে, বয়স্ক একজন পুরুষমানুষ সঙ্গে থাকা দরকার। এই মানুষটাকে লীলার খুবই পছন্দ।
জানালার বাইরে বিপুল অন্ধকার। হঠাৎ-হঠাৎ দু’একটা বাতি জ্বলতে দেখা যায়। বাতিগুলিকে লীলার কাছে মনে হয়। জিনের চোখ। বাতিগুলির দিকে তাকিয়ে থাকতে তার ভালো লাগছে। বাতিগুলি স্থির না। চলন্ত ট্রেনের কারণে হঠাৎ গাছের আড়ালে পড়ে বাতি উধাও হয়ে যাচ্ছে, আবার হুট করে অন্ধকার থেকে বের হচ্ছে। আলোর রঙও একরকম না; কোনোটা গাঢ় লাল, কোনোটা হালকা হলুদ। কোনোটা আবার নীলাভ। সবগুলি বাতির রঙ এক হওয়া উচিত। সবই তো কেরোসিনের আলো। রঙের বেশ-কমটা কি দূরত্বের জন্যে হচ্ছে? পরীক্ষা করতে পারলে হতো। লীলা পরীক্ষাটা করতে পারছে না, কারণ সে চোখই মেলে রাখতে পারছে না।
লীলা নিশ্চিত, কিছুক্ষণের মধ্যেই সে ঘুমিয়ে পড়বে। মজার কোনো স্বপ্ন দেখতে শুরু করবে। মঞ্জুমামাও উপরের বার্থে ঘুমিয়ে থাকবেন। তারা নান্দাইল রোড স্টেশন ছাড়িয়ে অনেকদূর চলে যাবে। একসময় মঞ্জুমামার ঘুম ভাঙবে। তিনি চিকন গলায় বলবেন–ধুনছে আমারে! তুলা ধুনা ধুনছে। ও লীলা, এখন করি। কী? লীলা বলবে, চলুন মামা আমরা চলন্ত ট্রেন থেকে লাফ দিয়ে নেমে পড়ি। মঞ্জুমামা অত্যন্ত বিরক্ত গলায় বলবেন, তোর মাথায় কি কিরা ঢুকছে? ট্রেন থেকে লাফ দিয়ে পড়লে তুই বাঁচবি? তোকে সঙ্গে নিয়ে বের হওয়াই ভুল হয়েছে। এইজন্যে শাস্ত্ৰে আছে পথে নারী বিবর্জিতা।
কোন শাস্ত্ৰে আছে?
কোন শাস্ত্ৰে আছে জানি না। কথা বলিস না, চুপ করে থাক। ধুনছেরে আমারে, ধুনছে। হায় খোদা এ কী বিপদ!
ট্রেনের গতি কি কমে এসেছে? ঘটাং ঘটাং শব্দ এখন হচ্ছে না। তার বদলে শো শো শব্দ হচ্ছে। লীলা বুঝতে পারছে সে ঘুমিয়ে পড়েছে, তবে কিছুটা চেতনা এখনো আছে। এক্ষুনি সে স্বপ্ন দেখতে শুরু করবে। সে স্বপ্ন দেখছে, শুরুতে এই বোধটা থাকবে।
লীলা এখন দেখছে সে হাতির পিঠে বসে আছে। হাতিটা দুলতে দুলতে এগোচ্ছে। স্বপ্ন দেখা তাহলে শুরু হয়েছে। লীলা ইচ্ছা করলেই স্বপ্ন নষ্ট করে জেগে উঠতে পারে। স্বপ্ন নষ্ট করতে ইচ্ছা করছে না। হাতির পিঠে চড়তে ভালো লাগছে। আরো কী কাণ্ড, বাদ্য-বাজনা হচ্ছে! কারা যেন আবার পিচকিরি দিয়ে রঙ ছিটাচ্ছে। লাল-নীল রঙ চোখে-মুখে লাগছে। রঙ উঠবে তো? হাতির মাহুত লীলার দিকে তাকিয়ে বলল— তাড়াতাড়ি নামো, তুফান হচ্ছে। মাহুত শুদ্ধভাষায় কথা বলছে। গলার স্বর মঞ্জুমামার মতো। লীলা বলল, নািমব কীভাবে? একটা সিঁড়ি লাগিয়ে দিন-না! মাহুত রাগী গলায় বলল— আরে বেটি তুফান হচ্ছে। এই বলেই ধাক্কা দিয়ে সে লীলাকে ফেলে দেবার চেষ্টা করতে লাগল। লীলার ঘুম ভেঙে গেল। সে অবাক হয়ে দেখে আসলেই তুফান হচ্ছে। ট্রেন থেমে আছে। কামরায় কোনো বাতি নেই। যাত্রীরা জানালা বন্ধ করার চেষ্টা করছে। ছোট একটা বাচ্চা কাঁদছে। একজন একটা টাৰ্চলাইট জুলিয়েছে। টাৰ্চলাইটের আলো ক্ষীণ। সেই ক্ষীণ আলোও আবার কিছুক্ষণ পরপর নিভে যাচ্ছে।
লীলা বলল, মামা, আমরা কোথায়?
মঞ্জু বিরক্ত গলায় বলল, আরো গাধা— ড্রাইভার জঙ্গলের মাঝখানে ট্রেন থামিয়ে দিয়েছে। আরো ব্যাটা, তুই কোনো স্টেশনে নিয়ে গাড়ি থামা। জংলার মধ্যে ট্রেন থামালি, এখন যদি ডাকাতি হয়?
ডাকাতি হবে কেন?
দেশ ভরতি হয়ে গেছে ডাকাতে। ডাকাতি হবে না? আজকাল ট্রেন অ্যাকসিডেন্ট হলে কী হয়? আশেপাশের চার-পাঁচ গ্রামের লোক চলে আসে। সাহায্য করার বদলে তারা করে লুটপাট। সুন্দরী মেয়ে থাকলে ধরে নিয়ে যায় পাটক্ষেতে।
লীলা বলল, মামা, শুধু—শুধু টেনশন করো না তো! কিচ্ছু হবে না।
মঞ্জু বিরক্ত গলায় বলল, কিছু হবে না তুই জানিস কীভাবে?
মিটমিটি করে এতক্ষণ যে টর্চলাইট জ্বলছিল সেটিও নিভে গেল। কামরার ভেতর গাঢ় অন্ধকার। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সেই আলোয় যাত্রীদের ভীত মুখ দেখা যাচ্ছে। লীলার জানালার পাশে হুড়মুড় শব্দ হলো। লীলা চমকে উঠে বলল, মামা, কী হয়েছে?
মঞ্জু বলল, গাছ ভেঙে পড়েছে, আর কী হবে! ঝড়ের মধ্যে গাধা-ড্রাইভার জঙ্গলে ট্রেন দাঁড় করিয়েছে। দেখিস পুরো জঙ্গলই ট্রেনের উপর ভেঙে পড়বে। পুরো ট্রেন পাটিসাপটা হয়ে যাবে। ভাই, আপনাদের কারো সঙ্গে দেয়াশলাই আছে? দেয়াশলাই থাকলে জ্বালান তো!
দেয়াশলাই-এর কাঠি জ্বলেই নিভে গেল। ট্রেনের জানালা বন্ধ, তার পরও হু-হু করে বাতাস ঢুকছে। যাত্রীদের মধ্যে একজন (টর্চের মালিক) মঞ্জুমামাকে লক্ষ করে বলল, আপনেরা যাইবেন কই?