বলো তো মা, জিনিসটা কী?
কহেন কবি কালিদাস পথে যেতে যেতে
নাই তাই খাচ্ছ, থাকলে কোথায় পেতে?
জইতরী-কইতরী দুজন একসঙ্গে বলল, পারব না।
আচ্ছা আরেকটা ধরি।
জইতরী বলল, প্রথমটা আগে ভাঙাও।
রমিলা বললেন, সবগুলা পরে একসঙ্গে ভাঙায়ে দিব। এখন আরেকটা শোনো—
আকাশে উড়ে না পক্ষী উড়ে না জঙ্গলে
এই পক্ষী উড়ে শুধু শনি মঙ্গলে।
পারব না।
তাহলে এটা ভাঙাও
মহাকবি কালিদাসের অতি আজব কথা
নয় লক্ষ তেঁতুল গাছের কয় লক্ষ পাতা?
পারব না।
দেখ এইটা পার কি-না—
তিন অক্ষরে নাম তার বৃহৎ বলে গণ্য
পেটটা তাহার কেটে দিলে হয়ে যায় অন্ন।
কইতরী আনন্দিত গলায় বলল, এইটা পারব। এটা ভারত। ভারতের পেট কাটলে হয়। ভাত।
হইছে। মা, তোমার খুব বুদ্ধি।
কইতরী বিড়বিড় করে বলল, মা, তুমি কি ভালো হয়ে গেছ?
রমিলা ছোট্ট করে শ্বাস ফেলে বললেন, এখন ভালো। মন্দ হইতে কতক্ষণ!
কইতরী বলল, শহরবাড়ি যাইবা?
না।
কইতরী বলল, তেঁতুল খাইবা? গাছ পাকনা তেঁতুল।
রমিলার তেঁতুল খেতে ইচ্ছা করছিল না, তারপরেও বললেন, আনো দেখি।
দুই মেয়েই দৌড়ে চলে গেল। লোকমানকে দেখা যাচ্ছে। সে অনেকক্ষণ থেকেই আশেপাশে হাঁটাহাঁটি করছে। পরপুরুষের সামনে পর্দা করা উচিত। কিন্তু লোকমান তাকে মা ডাকে। পুত্রের সামনেও কি পর্দার বিধান আছে? রমিলা মাথায় শাড়ির আঁচল তুলতে তুলতে লোকমানকে ইশারায় কাছে ডাকলেন। লোকমান প্রায় ছুটে এসে পাশে দাঁড়াল।
কেমন আছ লোকমান?
আম্মা, ভালো আছি।
ঘরদোয়ার বড়ই অপরিষ্কার। ঝাড় পোছ দেও। কুটুম আসব।
কে আসব আম্মা?
রমিলা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, যখন আসব তখন জানিবা। এখন সামনে থাইকা যাও।
রমিলা চোখ বন্ধ করলেন। তার মাথায় যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। ভোঁতা ধরনের চাপ ব্যথা। লক্ষণ মোটেই ভালো না। এই ব্যথা বাড়তে থাকবে। তারপর হঠাৎ করেই ব্যথা বোধ থাকবে না। শুরু হবে ভয়ঙ্কর সময়। যে সময়ের কোনো হিসেব তার কাছে থাকবে না। রমিলার উচিত অতি দ্রুত নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করার ব্যবস্থা করা। তার মন খারাপ লাগছে, মেয়ে দুটি আগ্রহ করে তেঁতুল আনতে গিয়েছে। এই তেঁতুল তারা দিতে পারবে না। তিনি বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে নিতে মেয়েদের সন্ধানে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন।
এই তো তাদেরকে দেখা যাচ্ছে। মেয়ে দুটাই তো সুন্দর হয়েছে। কই তরী একটু বেশি সুন্দর। শুধু যদি চুল কালো হতো! এই মেয়ের চুল। লাল। মেয়েদের লাল চুল ভালো না।
লাল চুলের মেয়েদের দিকে জিন-পরীর নজর থাকে।
বলে আমারো যেন তালাবন্ধ করে। আমার মাথা নষ্ট হইতে শুরু করছে।
জইতরী-কইতরী মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। রুমিলা ক্লান্তগলায় বললেন, তোমরা সাজগোজ কইরা থাকবা। বাড়িতে কুটুম আসতেছে।
কইতরী বলল, কুটুম কে মা?
রমিলা বললেন, তোমাদের বড় ভইন। তার নাম লীলা। লীলাবতী।
তোমারে কে খবর দিছে মা?
কেউ খবর দেয় নাই। আমি আগে আগে কিছু কিছু জিনিস জানি। ক্যামনে জানি বলতে পারব না।
রমিলা তেঁতুল হাতে নিয়ে তাঁর ঘরের দিকে রওনা হলেন। চোখের সামনে অন্ধকার নেমে আসছে। আর দেরি করা ঠিক না।
লীলা ট্রেনের জানালায় মাথা রেখে বসে আছে। তার চোখে চশমা। চশমা নড়বড় করছে। মনে হচ্ছে যে-কোনো সময় আলগা হয়ে নিচে পড়ে যাবে। খাপ করে হাত বাড়িয়ে ধরার সময় পাওয়া যাবে না। কারণ তার দু’টা হাতই বন্ধ। সে মাথা রেখেছে হাতের উপর। ট্রেন ঝড়ের গতিতে চলছে। প্ৰচণ্ড বাতাস। বাতাসে লীলার চুল উড়ছে। অল্প স্বল্প বাতাসে চুল উড়ে যখন মুখের উপর পড়ে তখন তার খুব বিরক্তি লাগে। এখন বিরক্তি লাগছে না। বরং উল্টোটা হচ্ছে, খুবই ভালো লাগছে। ভালো লাগার সঙ্গে খানিকটা ভয় যুক্ত হয়েছে— মাথার উপরের জানোলা খটখট করছে। ট্রেনের ঝাকুনিতে ধুম করে যে-কোনো সময় হয়তো মাথার উপর পড়বে।
লীলার বয়স একুশ। তার মুখ লম্বাটে। গায়ের রঙ সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে তাকে খুব ফরসা লাগে। আবার কখনো মনে হয় শ্যামলা। সব মানুষের চেহারায় কিছু বিশেষত্ব থাকে। লীলার বিশেষত্ব হচ্ছে, তাকে দেখেই মনে হয় সে খুব কথা বলে। আসলে ব্যাপারটা উল্টা। লীলা খুবই কম কথা বলে। তবে অন্যরা যখন কথা বলে সে সারাক্ষণই মুখ টিপে হাসতে থাকে এবং এমন আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকে যে মনে হয় এ-ধরনের কথা সে আগে কখনো শোনে নি, ভবিষ্যতে শোনার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। যা শোনারএখনি শুনে নিতে হবে।
ট্রেনের বাকুনিতে লীলার ঘুম-ঘুম লাগছে। সে বেশ কষ্ট করে জেগে আছে। সামনের স্টপেজটাই নান্দাইল রোড। তাকে নামতে হবে নান্দাইল রোডে। ট্রেন সেখানে মাত্র দুমিনিটের জন্যে থামবে। এই নিয়েও কিছু সমস্যা আছে, তাকে ট্রেনের যাত্রীরা বলেছে, মেইল ট্রেন নান্দাইল রোডে থামে না। যদি সত্যি সত্যি না থামে। তাহলে বিস্ময়কর ব্যাপার হবে। সে টিকিট কেটেছে নান্দাইল রোডের। ট্রেন না থামলে টিকিট কেন দেয়া হবে?
লীলার সঙ্গে এমন কিছু মালপত্র নেই। একটা বড় সুটকেস, একটা হ্যান্ডব্যাগ। হ্যান্ডব্যাগ সে হাতে করে নামাবে। সুটকেস নামাঝে মঞ্জুমামা। মঞ্জুমামা এখন উপরের বার্থে শুয়ে হাঁ করে ঘুমুচ্ছেন। ট্রেনের গতি কমে এলে তার ঘুম ভাঙাতে হবে। ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে তিনি অতিরিক্ত ব্যস্ত হয়ে পড়বেন। টেনশনে তার গলার স্বর চিকন হয়ে যাবে। এমনিতে তার গলার স্বর ভারী, শুধু টেনশনের সময় গলা চিকন হয়ে যায়। লীলা ভেবেই পায় না একটা মানুষ সারাক্ষণ এত টেনশনে কী করে থাকে! তার চেয়েও আশ্চর্য কথা— এত টেনশন নিয়ে একটা মানুষ যখন-তখন কী করে ঘুমিয়ে পড়ে?