রূপা উঠে দাঁড়াল। বাথটাবে কাগজ আরো কিছুক্ষণ ভিজলেও ক্ষতি হবে না। এই মুহূর্তে তার ইচ্ছা করছে বাবার ব্যস্ত মুখ দেখতে। বাবা যেখানেই যান মাইক্রোবাস ভর্তি জিনিসপত্র নিয়ে আসেন, কলার কাদি, মানকচু। মাটির হাঁড়িতে জিয়ল মাছ। একবার দুটা রাজহাঁস নিয়ে এসেছিলেন। ছাড়া পেয়েই দুটা হাঁসের একটা ছুটে এসে রূপার হাঁটুতে ঠোকর দিয়েছিল।
রূপা বারান্দায় এসে দাঁড়াল। হারুন ব্যস্ত ভঙ্গিতে জিনিসপত্র নামাচ্ছেন। একটু দূরে কাপড়ের পুঁটলি হাতে দশ-এগারো বছরের এক বালিকা। বালিকার গাত্রবর্ণ ঘন কালো। তার মুখ গোলাকার। এতই গোল যে দেখে মনে হয় কাঁটা কম্পাস দিয়ে আঁকা।
গোলাকার মুখের সঙ্গে মিলিয়ে বড় বড় গোল চোখ। গোল চোখে আপনাতেই বিস্ময় ভাব চলে আসে। বালিকার চোখের বিস্ময় নেই, বিষণ্ণতা আছে।
হারুন রূপার দিকে তাকিয়ে বললেন, হ্যালো ইয়াং লেডি।
রূপা বলল, হ্যালো ওল্ড বাবা। এই কি তোমার ঘড়ি-কন্যা?
হারুন বললেন, ইয়েস।
জীবন্ত ঘড়ি নিয়ে চলে এসেছ?
হুঁ। ঘরের টুকটাক কাজ করবে। স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেব। পড়াশোনা করবে।
বাবা-মা ছেড়ে দিল?
না দিয়ে করবে কি? একবেলা খাওয়া জুটে তো দুই বেলা জুটে না এমন অবস্থা। আমি যখন বললাম, মেয়েটাকে আমার কাছে দিয়ে দাও, তারা মনে হল আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে। মেয়েটাকে কাছে ডেকে দুএকটা কথা বল। ঘড়ির সময় জিজ্ঞেস কর। ওর ভয়টা কাটিয়ে দে।
সে ভয় পাচ্ছে না বাবা।
ভয় অবশ্যই পাচ্ছে। বস্তি থেকে উঠে আসা মেয়ে। প্রথম ঢাকা শহরে এসেছে। ভয় পাবে না মানে?
নাম মদিনা! তাই না বাবা?
হুঁ। বাবা-মা ডাকে লতি।
নাম মদিন, বাবা-মা লতি ডাকবে কেন?
আমি জানব কীভাবে? আমাদের বাড়িতে তার স্টেটাস কি?
কাজের মেয়ে? তার স্টেটাস হচ্ছে A gifted child.
হারুন গলা উঁচিয়ে ডাকলেন, লতি এদিকে আস। তোমার আপার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেই।
মদিনা এগিয়ে এল। তার আসার মধ্যে কোনো জড়তা নেই। রূপার আবার মনে হল, নতুন পরিবেশে এসে মেয়েটা মোটেই ভয় পাচ্ছে না। ভয় না পেলেও কৌতূহল থাকবে। মেয়েটার চোখে কৌতূহলও নেই।
হারুন বললেন, লতি! রাজকন্যার মতো যে মেয়েটাকে দেখছ সে হচ্ছে আমার মেয়ে। তার কথা তোমাকে বলেছি। ছবি আঁকে। আমার মেয়ের নাম রূপা তাকে তুমি আপা ডাকবে।
রূপা বলল, মদিনা এসো আমার সঙ্গে। আমি জরুরি কিছু কাজ করছি। কাজ করতে করতে গল্প করব।
মদিনা মেঝেতে মাথা নিচু করে বসেছে। আরচোখে রূপার কাজ দেখছে। রূপা বাথটাব থেকে ভেজা কাগজ মেঝেতে বিছিয়ে দিল। কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে মদিনার দিকে তাকিয়ে থাকলো। মদিনাও চোখ তুলে তাকালো। দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে।
রূপা বলল, নতুন জায়গায় এসে তোমার কি ভয় লাগছে?
মদিনা মুখে কিছু বলল না, তবে মাথা নেড়ে জানালো তার ভয় লাগছে। রূপা বলল, ভয় লাগার কিছু নেই। আমার বাবা অত্যন্ত ভাল মানুষ। ভাল মানুষের ছেলেমেয়েরাও ভাল মানুষ হয়। আমিও ভাল মেয়ে।
মদিনা বলল, আপনি যে ভাল মেয়ে আমি জানি।
রূপা বলল, কীভাবে জান?
মদিনা জবাব দিল না।
রূপা বলল, এ বাড়িতে তোমার প্রধান কাজ কি হবে জান? তোমার প্রধান কাজ হবে আমাকে সাহায্য করা। কাগজ পানিতে ভেজানো, শুকানো, বোর্ডে কাগজ বসিয়ে টেপ লাগানো, রঙের টিউবের মুখ বন্ধ করা, ব্রাশ পরিষ্কার করা এইসব। আমি কি করি দেখবে। দেখে দেখে শিখবে।
মদিনা ঘাড় কাত করে জানালো সে শিখবে।
তুমি কি লেখাপড়া জান?
ক্লাস ফাইভ পাস করছি।
খুব ভাল। এখন তুমি একটা কাজ কর। তোমার এই মুহূর্তে কি কি লাগবে একটা কাগজে লিখে আমার কাছে দাও। আমি আনিয়ে দেব। একই সঙ্গে তোমার হাতের লেখারও একটা পরীক্ষা হবে।
আমার কিছু লাগবে না।
অবশ্যই লাগবে। তুমি খালি পায়ে এসেছ। তোমার একজোড়া স্যান্ডেল লাগবে। টুথপেস্ট, ব্রাশ লাগবে। মুখে মাখার ক্রিম লাগবে, নারিকেল তেল লাগবে, সাবান, তোয়ালে লাগবে।
মদিনা হাসল। রূপা লক্ষ করল মেয়েটার হাসি অস্বাভাবিক সুন্দর। বেশির ভাগ মানুষ যখন হাসে শুধু তাদের ঠোঁট হাসে। চোখ হাসে না। এই মেয়েটার ঠোঁট এবং চোখ একসঙ্গে হাসছে।
আফা একটা কথা বলব?
বল।
আপনার এই বাড়িতে ভূত আছে।
তাই নাকি?
জী। খারাপ ভূত।
ভূতের ভাল-খারাপ আছে?
হুঁ।
তুমি কি ভূতটাকে দেখতে পাচ্ছি?
হুঁ! ঘরের কোনায় খাড়ায়া আপনার দিকে তাকায়াছিল। এখন নাই।
রূপা হাতের কাজ বন্ধ করে কিছুক্ষণ মদিনার দিকে তাকিয়ে বলল, মদিনা শোন, ভূত-প্রেত, রাক্ষস-খোক্কস এইসব পৃথিবীতে নেই। মানুষ কল্পনা করতে ভালবাসে বলে এইসব কল্পনা করে। তুমি এখন মলিনার কাছে। যাও। মলিনা দেখিয়ে দেবে তুমি কোথায় থাকবে। তোমাকে যে লিস্ট করতে বলেছি লিস্টটা করবে। মলিনাকে বল আমাকে এক কাপ চা বানিয়ে দিতে। তুমি কি চা বানাতে পার?
না।
মলিনার কাছ থেকে শিখে নেবে কীভাবে চা বানাতে হয়। পারবে না?
পারব।
রূপা মদিনার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ অন্য রকম গলায় বলল, আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে বল কয়টা বাজে।
মদিনা বলল, বলতে পারব না।
বাবা বলছিল, জিজ্ঞাস করা মাত্র তুমি সময় বল।
সবসময় পারি না। মাঝে মাঝে পারি।
আচ্ছা যাও।
মদিনা উঠে দাঁড়াল। নীচু গলায় বলল, আফা ভূতটা আবার আসছে। ঐ যে কোনায় খাড়ায়া আছে।
রূপা বলল, ভূত ভূতের মতো দাঁড়িয়ে থাকুক। তোমাকে যা করতে বলেছি কর।
দুপুরে খেতে বসে হারুন বললেন, ঐ ছেলে রাশেদ না ফাসেদ কি যেন নাম, সে কি তার জিনিসপত্র নিয়ে গেছে?