গাতক কি?
সংগীত যে জানে তারে কয় গাতক। আপনেরে সরম পাইতেছে। সরম ভাঙলে গানে টান দিব। খুব ইচ্ছা ছিল তারে ক্ষুদে গান রাজ-এ দিব। ক্যামনে দিতে হয় জানি না বইল্যা পারলাম না।
ক্ষুদে গান কি?
টেলিভিশনে পুলাপানের গান। যারা ফার্স্ট সেকেন্ড হয় তারা লাখ লাখ টেকা পায়, বাড়ি পায় তারপর ধরেন লন্ডন যায়, বিলাত যায়।
আপনার ছেলে কি ফাস্ট হওয়ার মতো গান গায়?
অবশ্যই। যদি না পায় তাইলে আমি একটা কান কাইট্যা আপনেরে দিয়া দিব। আপনে কুত্তারে দিয়া খাওয়ায় দিবেন। বাকি জীবন এক কান নিয়া ঘুরব। এই ওয়াদা করলাম।
রাশেদ বলল, খোকা শুনি একটা গান।
পামু না।
কেন না?
আমি আপনেরে সরমাই।
বৃষ্টির জোড় বেড়েছে। টিনের ছাদে ঝুমুর ঝুমুর শব্দ। রাশেদ বলল, I am a blessed person no doubt of that, what an experience.
সামছু বলল, স্যার কি কইছেন বুঝি নাই।
বললাম, আমি একজন সুখী মানুষ।
সামছু বলল, অনেক বকর বকর করেছি। স্যার ঘুম দেন। মশা নাই। ঝুম বৃষ্টির মধ্যে মশা আসে না। আর যদিও আসে মশার কয়েল দিয়া দিব।
বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে রাশেদ গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল। ঘুমের মধ্যেই শুনল কে যেন গান করছে—
মানুষ ধর মানুষ ভজ শুন বলি এ পাগল মন।
মানুষের ভিতর মানুষ করিতেছে বিরাজন॥
সামছুর ছেলে গান করছে। সামছু একটু পর পর বলছে–সব্বাস ব্যাটা। সাব্বাস। স্যার ঘুমায়া পড়ছেন। স্যার জাগনা থাকলে পুরস্কার পাইতি।
স্বর্গের অপ্সরাদের আরেক নাম কিন্নর। কিন্নরদের আছে ত্রিকাল ভুলানি কণ্ঠ। হতদরিদ্র সামছুর মাতৃহারা শিশুটি পৃথিবীতে এসেছে কিন্নর কণ্ঠ নিয়ে। সেই কিন্নর কণ্ঠ প্রকাশিত হবার জন্যেই হয়ত বৃষ্টিস্নাত রজনিতে রাশেদের প্রয়োজন ছিল। প্রকৃতি রাশেদকে নিয়ে এসেছে কিন্নর কণ্ঠের কাছে। প্রকৃতি লীলাময়, তার লীলা বোঝা বড়ই কঠিন।
সামছু মিয়া খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে চুলা ধরাল। বৃদ্ধের দলের কেউ কেউ মর্নিং ওয়াকে যাবার সময় তার স্টলে চা খায়। দুধ চিনি ছাড়া লিকার চা, আদা চা এবং লেবু।
আজ কেউ আসবে না, এখনো বৃষ্টি পড়ছে। আকাশ ঘন কালো। দীর্ঘ জীবন পিয়াসী বৃদ্ধের দল আজ এই বৃষ্টিতে বের হবে না। সকালের প্রথম ব্যবসা মার গেল।
রাশেদ জেগেছে। তার চোখ খোলা। সামছু বলল, ঘুম ভাল হইছে স্যার?
রাশেদ বলল, না। সারারাত আজেবাজে স্বপ্ন দেখেছি।
স্বপ্ন কি দেখছেন?
জন্তুর মতো একটা কি যেন কামড়ে কামড়ে আমার পা খাচ্ছে। আমার প্যারালাইসিস। হাত পা নাড়াতে পারছি না। চিৎকার করে কাউকে ডাকতেও পারছি না। গলা দিয়ে স্বর বের হচ্ছে না।
একটা মুরগি ছদকার ব্যবস্থা করেন স্যার।
মুরগির ছদকা ব্যাপারটা কি?
একটা মুরগি কিনবেন। গরিব মিসকিনরে দিয়া দিবেন। স্বপ্নের দোষ কাটা যাবে। স্যার চা খাবেন?
না। আমার ধারণা আমার জ্বর এসেছে। মুখ দিয়ে ভাপ বের হচ্ছে। আপনার কাছে থার্মোমিটার আছে? জ্বর মাপার যন্ত্র?
জ্বে না। আমরা গরিব মানুষ। মাথায় হাত দিয়া জ্বর মাপি।
আমার মাথায় হাত দিয়ে জ্বরটা মাপুন তো।
সামছু রাশেদের মাথায় হাত রাখল। রাশেদ বলল, জ্বর আছে?
আছে।
বেশি? জী বেশি। খুব বেশি।
আমার নিজেরও তাই ধারণা। নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। জনু থেকেই আমার লাংসে কিছু সমস্যা আছে। আপনি কি আমাকে ভালো কোনো হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারবেন?
অবশ্যই পারব।
ঢাকার সবচে বড় হাসপাতালের নাম কি?
সেটা তো স্যার জানি না।
সামছু লক্ষ করল মানুষটার চোখ লাল। ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছে। মুখ থেকে শাঁ শাঁ শব্দ আসছে।
সামছু বলল, কি করি কিছুই তো বুঝতে পারতেছি না। স্যার পানি খাবেন?
না। বমি আসছে। আপনি একজন ডাক্তারের ব্যবস্থা করতে পারবেন?
স্যার পারব। ডাক্তারের ভিজিট ক্যামনে দিব?
আমার কাছে ডলার আছে।
রাশেদ কথা শেষ করতে পারল না। বমি শুরু করল। বমির সঙ্গে রক্ত আসছে।
সামছু বলল, ইয়া খোদা এখন কি করি? বাবা কেনতু! এখন করবটা কি?
কেনতু বলল, ডাক্তার ডাক। দৌড় দেও।
সামছু দোকান থেকে নেমে দৌড়াতে শুরু করল।
রূপা ছবি আঁকতে বসেছে
রূপা ছবি আঁকতে বসেছে। জলরঙের ছবি আঁকার আয়োজন অনেক। পেপারে ট্রিটমেন্ট দিয়ে আয়োজনের শুরু। বাথটাবে হ্যান্ডমেড পেপার ভেজানো হয়েছে। ভেজা কাগজ রোদে খানিকটা শুকিয়ে রঙের প্রথম ওয়াশ দিতে হবে। জলরঙ ছবির বিষয়বস্তু আগেভাগে ঠিক করা কঠিন। ছবি তার নিজের প্রাণে এগিয়ে চলে। তারপরেও রূপা ঠিক করে রেখেছে তার ছবির মূল বিষয় হবে জানালা। জানালা দিয়ে ঘরে রোদ ঢুকছে এ রকম ছবি। ছবির নাম রোদ্র। কিংবা রোদ। রোদের আলাদা কোনো ইংরেজি প্রতিশব্দ নেই। রোদ হচ্ছে Sunshine, একইভাবে জোছনা Moonshine. কবি-সাহিত্যিকরা নতুন নতুন শব্দ তৈরি করেন। ইংরেজি ভাষার কেউ রোদ এবং জোছনার কোনো প্রতিশব্দ কেন করলেন না ভাবতে ভাবতে রূপা একটা শব্দ নিজেই তৈরি করল, রোদ হল Sube. তার ছবির নাম Sube. কেউ যদি জিজ্ঞেস করে Sube কি? সে বলবে রোদ। একইভাবে জোছনা হল Mube.
রূপা ডিকশনারি খুলল, হয়ত দেখা যাবে sube বলে কোনো শব্দ আছে। Oxford Advanced Learners Dictionary-তে Sube বা Mube নামে কোনো শব্দ নেই। কাজেই ছবির নাম sube রাখা যেতে পারে।
আফা, খালুজান আসছে। সাথে একটা মাইয়া নিয়া আসছে। মাইয়াটারে দেইখা মনে হয় দোয়াইতের কালি দিয়া সিনান কইরা আসছে। এমুন কালা মাইয়া আমি বাপের জন্মে দেখি নাই। মা কালীও এই মাইয়ার কাছে ফর্সা।