আমি বয়সে তোমার চেয়ে বড়। কাজেই তুমি বলেছি। এটা বড় কোনো অন্যায় না। অসৌজন্যমূলক কোনো আচরণও না। সামাজিকভাবে স্বীকৃত আচরণ ব্যবস্থা।
আমি যে দেশে বাস করছি সেখানে আপনি তুমি তুই নেই। সবাই তুমি। আমার ভুল সেখান থেকেও হতে পারে।
কোনো মানুষই বিচ্ছিন্ন দ্বীপ না। সবার সঙ্গে সবার সম্পর্ক। তুমি আমার সঙ্গে অত্যন্ত ভদ্র ব্যবহার করেছ। ভুল করে তোমার বাড়িতে উঠে পড়েছি জেনেও তুমি সঙ্গে সঙ্গে আমাকে বের করে দাওনি। বরং ঝড়-বৃষ্টিতে বের না হয়ে রাতে ডিনার করে থেকে যেতে বলেছ। কাজেই তোমার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হয়নি তা-না। ঘনিষ্ঠতা হয়েছে। এই ঘনিষ্ঠতার কারণে আমি তোমাকে তুমি বলতে পারি।
আচ্ছা ঠিক আছে ধরে নিলাম আমি তোমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করার জন্যে তুমি বলেছি। এতেই সমস্যা কি? মানুষের স্বভাব হচ্ছে ঘনিষ্ঠ হওয়া। দূরে সরে যাওয়া না।
রাশেদের হঠাৎ পা পিছলালো। সে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। কাদায় পানিতে মাখামাখি হয়ে উঠে দাড়াল। বিদেশের অচেনা পথঘাটে সাবধানে হাঁটতে হয়। বাংলাদেশ এখন তার কাছে বিদেশ। তার পাসপোর্ট আমেরিকান। তার অনেক সাবধানে হাঁটা উচিত ছিল।
ঠাণ্ডায় শরীরে কাঁপুনি উঠে গেছে। বুকে ঠা না বসলেই হল। তার লাংসে সমস্যা আছে। যে পরিমাণ রক্ত তার লাংসের পরিষ্কার করার কথা সে পরিমাণ করতে পারে না।
চারদিক জনশূন্য। এমন কিছু রতি হয়নি যে সব লোকজন ঘরে ঢুকে খেয়ে-দেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ ঝড়-বৃষ্টির দেশ। সামান্য দমকা বাতাসে শহরের পথঘাট জনশূন্য হবার কথা না। রাশেদ অন্যমনস্কভাবে কিছুদূর হাঁটল। রাস্তার মাথায় একটা চায়ের দোকান দেখা যাচ্ছে। চুলায় আগুন জ্বলছে। আগুন দেখা যাচ্ছে। দোকানি চাদর গায়ে দিয়ে গুটিসুটি মেরে বসে আছে। দোকানির সঙ্গে ছয় সাত বছরের একটা ছেলে। সে একই চাদরের নিচে। সম্ভবত দোকানির ছেলে। রাশেদ এগিয়ে গেল।
শীতে তার শরীর কাঁপছে। দাঁতে দাঁত লেগে কটকট শব্দ হচ্ছে। রাশেদ বলল, আমাকে আগুন গরম এক কাপ চা খাওয়াতে পারবেন?
দোকানি বলল, পারব স্যার। ইশ আপনার কি অবস্থা!
পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলাম।
আপনার কপাল কাটছে? রক্ত পড়তাছে।
পড়ুক রক্ত। আপনার দোকানে খাবার কি আছে? আমি খুব ক্ষুধার্ত। দুপুরে লাঞ্চে দিয়েছিল স্যালমন মাছ। মাছ খেতে পারি না বলে খাইনি। এখন ক্ষুধায় মারা যাচ্ছি।
কেক আছে, খাবেন? কেক কিন্তু টাটকা না, বাসি।
কত দিনের বাসি?
এক হপ্তা।
কেক বাদ। আর কি আছে?
ডিম আছে। ডিম সিদ্ধ করে দিলে খাবেন?
হ্যাঁ খাব। থ্যাংক য়্যু।
আপনে বাইরে দাঁড়ায়া বিষ্টিতে ভিজতেছেন। ভিতরে আসেন। একটা গামছা দেই। মাথাটা মুছেন।
থ্যাংক য়্যু এগেইন। ভাই আপনার নাম কি?
সামছু।
সামছু আমি একটা জরুরি কথা বলতে ভুলে গেছি। আমার সঙ্গে বাংলাদেশি কোনো টাকা নেই। আমেরিকান টাকা আছে, ডলার।
স্যার টেকা পরে দিয়েন অসুবিধা নাই। আপনে কই মেলা দিছেন?
মেলা দিছেন মানে কি?
যান কই?
ভাল কোনো হোটেলে যাব। রাতটা হোটেলে থাকব।
সামছু চায়ের কাপ এগিয়ে দিল। কেটলিতে দুটা ডিম ছেড়ে দিতে দিতে বলল, সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস আছে স্যার? একটা সিগারেট দেই। টান দিলে শীতটা কমব।
সিগারেট খাই না।
স্যার গরিবের একটা কথা কি শুনবেন?
অবশ্যই শুনব।
ঢাকা শহর নষ্ট হয়ে গেছে, ছিনতাইকারী, মলম পার্টি, মরিচগুড়া পার্টি। এত রাইতে হোটেলে যাওয়ার চিন্তা বাদ দেন।
রাতে থাকব কোথায়? আমার রাতে থাকার কোনো জায়গা নেই।
আমার এই দোকানে থাকবেন? আমরা বাপ-বেটায় রাইতে দোকানে থাকি। নয়া একটা লুঙ্গি খরিদ করেছি। সেলাই হয় নাই বইল্যা পরি নাই। লুঙ্গি পেঁচায়া শুইয়া পড়বেন। এক ঘুমে রাইত পার।
আমি খুব আগ্রহের সঙ্গে এবং আনন্দের সঙ্গে আপনার দোকানে থাকব। এবং কৃতজ্ঞতার সঙ্গে আপনার দয়ার কথা সারাজীবন মনে রাখব।
সামছু জিভে কামড় দিয়ে বলল, স্যার কি যে কন। আমি গরিব মানুষ, আমার কি দয়া করার কোনো ক্ষমতা আছে? গরম পানি দেই সিনান করেন।
গরম পানি কোথায় পাবেন?
কেতলিতে গরম পানি বলক উঠতাছে। সিনান কইরা দোকানে উঠেন। তারপর খানা।
রাশেদের হট বাথের শখ ছিল সে আয়েশ করেই হট বাথ নিল। বালতিতে গরম পানি, মাথায় পড়ছে ঠাণ্ডা পানি। একইসঙ্গে হিমশীতল পানি এবং গরম পানির ধারা স্নান। খেতে বসেও চমক। খিচুড়ি সঙ্গে ডিমের ভর্তা। রাশেদ আনন্দিত গলায় বলল, খিচুড়ি কোথায় পেয়েছেন?
সামছু বলল, বাপ-বেটা না খায়া থাকব? খিচুড়ি সইন্ধ্যা ওয়াক্তে আমরা খাইছি। সকালের নাশতার জন্য কিছু ছিল সেইটা আপনারে দিলাম! খাইতে কি সোয়াদ হইছে স্যার?
অমৃতের মতো লাগছে। আপনাকে ধন্যবাদ।
আমারে খামাখা ধন্যবাদ দেন কি জন্যে? আল্লাপাক আপনের রিজিক রাখছে এইখানে, প্রত্যেকটা দানার মধ্যে আপনার নাম লেখা।
প্রতি দানায় আমার নাম লেখা?
জ্বে। যে দানায় নাম লেখা নাই সেই দানা মুখে দিতে পারবেন না। ভুলক্রমে মুখে দিলেও থু করে ফেলে দিতে হবে। আল্লাহ পাকের এমনই হিসাব।
দোকানে পাটিপাতা। তার উপরে পত্রিকার কাগজ বিছানো হয়েছে। সামছু বলল, কম্বলটা গায়ে দেন। গত বছর শীতের সময় দুইটা কম্বল পাইছিলাম। কমিশনার সাব দিছিলেন। রাতটা কষ্টমষ্ট কইরা পার করেন।
রাশেদ বলল, আমি খুব আনন্দ করে রাতটা পার করব।
সামছু বলল, আমার পুলা কিন্তু গাতক আছে।