ছবিটা দেখে তোমার কেমন লাগছে সেটা বল। নাম কোনো ব্যাপার না।
হারুন বললেন, দর্শক নামের সঙ্গে ছবি রিলেট করবে। নাম ব্যাপার হবে না কেন? মনে কর আমি একটা গোলাপের ছবি এঁকে ছবির নাম দিলাম হংস ডিম্ব! তার কোনো অর্থ হবে?
বাবা! ধরে নাও ছবিটার কোনো নাম নেই। এখন বল ছবি কেমন লাগছে।
হারুন গম্ভীর গলায় বললেন, ছবি দেখে মনে হচ্ছে পেইন্টারের কাছে নীল রঙের একটা টিউবই ছিল। সে তা দিয়েই ছবি আঁকার চেষ্টা করেছে। চেষ্টা খুব যে সফল হয়েছে তাও না।
বাবা তুমি ইতিহাস বুঝ, ছবি বুঝ না।
সেটাই তো স্বাভাবিক রে মা। তোরা যারা ছবি আঁকিস তারা ছবি বুঝবি। ইতিহাস বুঝবি না।
বাবা, আমি ওয়াটার কালারে গোল্ড মেডেল পাওয়া মেয়ে।
ক্রিয়েটিভ ক্ষেত্রে গোল্ড মেডেল কোনো কাজের কথা না। পিকাসো কখনো গোল্ড মেডেল পান নি। জয়নুল আবেদিন কোলকাতা আর্ট স্কুল থেকে পাস করেছিলেন। তার রেজাল্ট ভাল ছিল না। পাকিস্তানের ওরিয়েন্টাল পেইন্টার আবদুর রহমান চুঘতাই আর্ট কলেজের পরীক্ষায় ফেল করেছিলেন।
বক্তৃতা বন্ধ কর বাবা।
শেষ কথাটা শোন Louvre Museum-এ ভারতবর্ষের মাত্র একজন পেইন্টারের ছবি আছে। তিনি কখনো আর্ট স্কুলে বা কলেজে পড়েন নি। তার নাম জানতে চাস?
না।
জেনারেল নলেজ বাড়াবি না?
না।
তার নাম অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর রবীন্দ্রনাথের কে হন সেটা বল।
আমি জানি না। দয়া করে এখন চুপ কর।
আচ্ছা যা চুপ করলাম। জন্মে মীন রাশি নিয়ে মন খারাপ করিস না। যখন ভাল ছবি আঁকবি আমিই প্রথম বলব।
তোমার কিছু বলার দরকার নেই। রূপা বসে আছে চৌবাচ্চার দক্ষিণ দিকে। আকাশে মেঘ জমছে। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। চৌবাচ্চার পানিতে বিদ্যুৎ চমকের প্রতিবিম্ব পড়ার সঙ্গে মাছদের জগতে এক ধরনের আলোড়ন তৈরি হচ্ছে। রূপার দেখতে মজা লাগছে। মাছরা ভয় পাচ্ছে। সবচে বেশি ভয় পাচ্ছে তেলাপিয়াগুলি। বিদ্যুৎ চমকের সঙ্গে সঙ্গে এরা লাফিয়ে পানি থেকে শূন্যে উঠে যাচ্ছে। একটা মাছ তো রূপার কোলে এসে পড়তে পড়তে পড়ে নি।
রূপাদের দোতলা বাড়িটা কলাবাগানের ভেতরের দিকে। তাদের বাড়ির পাশ দিয়েই ভূতের গলি গিয়েছে। রূপার দাদা এক বিঘা জমিতে ছোট্ট একটা দোতলা বাড়ি বানিয়ে বাড়ির নাম দিয়েছিলেন ভূতের বাড়ি। তিনি বৃক্ষপ্রেমিক মানুষ ছিলেন। বাড়ি ঘিরে নানান ধরনের গাছপালা লাগিয়েছিলেন।
ভূতের বাড়ি নামকরণের জন্যেই কি-না কে জানে এই বাড়িতে ভূতের খুব উপদ্রপ শুরু হয়। নিশিরাতে ছাদে নূপুর পায়ে হাঁটার শব্দ। ঝড় নেই, বাতাস নেই, আপনাআপনি জানালা বন্ধ হচ্ছে, খুলছে। রান্নাঘরের মিটসেফের সব খাবার দেখা যায় রান্নাঘরময় ছড়ানাে।
রূপার দাদা হাজী শরিফউদ্দিন নিজেও একদিন ভূতের হাতে পড়লেন। রাতে বাথরুমে গিয়েছেন। তারপর আর বাথরুম থেকে বের হতে পারেন না। দরজা খুলে না। তিনি ছিলেন দোতলায় একা। এক তলায় একজন দারােয়ান আর রান্নার ছেলে। শরিফউদ্দিন চিৎকার করে গলা ফাটাচ্ছেন। কেউ শুনছে না।
দরজা খুলল ফজরের আযানের পর। শরিফউদ্দিন বাড়ি ছেড়ে গ্রামে চলে গেলেন। ভূতের বাড়ি পরিত্যক্ত হয়ে গেল।
রূপার জন্মের পর বাড়ির নাম বদলে হারুন বসবাস শুরু করলেন। বাড়ির নতুন নাম হল রূপা। রূপার ধারণা তাদের বাড়িতে এখনাে ভূত আছে তবে ভূতদের আগের সেই ক্ষমতা নেই। আশেপাশে বিশাল সব অ্যাপার্টমেন্ট হাউস হওয়ায় তারা কোনঠাসা হয়ে আছে।
বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করেছে। রূপা দোতলা থেকে একতলায় নামল। মলিনার সঙ্গে সিঁড়ির গােড়াতেই দেখা। মলিনা বলল, আফা খানা লাগামু?
উনি বিদায় হয়েছেন?
জ্বে না। একবার আমারে বললেন, ঠাণ্ডা এক গ্লাস পানি দাও। পানি দিলাম। পানি খাইয়া আবার ঘুম। আমারে বললেন, তােমার নাম মলিনা, অর্থাৎ মলিন। নামটা সুন্দর না। এখন থেকে আমি তােমাকে ডাকব মলি। আমি বললাম, ভাইজান আপনের যা মনে চায় ডাকবেন। আমার কোনাে সমস্যা নাই। আমারে মহারানী ডাকলেও যা, মরনি ডাকলেও তা।
রূপা বলল, তুমি কি তাকে বলেছ যে উনি ভুল ঠিকানায় এসেছেন ?
বলার সুযোগ কই পাইলাম আফা। উনি আছেন ঘুমের মধ্যে। আমারে বলেছেন প্লেইনে উঠলে কি জানি হয়। তখন খালি ঘুম ধরে। দুই তিন দিন সমানে ঘুমাইতে হয়। আজব ব্যাপার না আফা? আল্লাহ বাচাইছে যে আমি কোন দিন প্লেইনে উঠি নাই।
হারুন আবার টেলিফোন করেছেন। তাঁর উদ্বিগ্ন গলা শোনা গেল।
ব্যাটা বিয়ে হয়েছে?
না।
কেন? কি করছে?
ঘুমাচ্ছে।
রূপা! তুই ঠিক করে বল তো সমস্যা কি?
আমি তেমন কোনো সমস্যা দেখছি না। জেট লেগের ধাক্কায় পড়ে ঘুম দিয়েছে। তার ঘুম ভাঙানো যাচ্ছে না।
আমি টেলিফোন ধরে আছি–যা থাপ্পড় দিয়ে ঘুম ভাঙ্গা। কষে থাপ্পড় দিবি যেন আমি টেলিফোনে থাপ্পড়ের শব্দ শুনতে পাই।
বাবা অস্থির হয়ো না।
অজানা অচেনা একজন ট্রেসপাস করেছে আমি অস্থির হব না?
না। কারণ এতদূর থেকে অস্থির হয়ে তুমি কিছু করতে পারবে না। যে ট্রেসপাস করেছে সে কোনো সন্ত্রাসী না।
বুঝলি কি করে?
চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝেছি।
চোখের ডাক্তার হয়ে গেছিস? ফাজিল মেয়ে। পাঁচ মিনিট সময় দিলাম, এর মধ্যে যন্ত্রণা বিদায় করবি। পাঁচ মিনিট পর আবার টেলিফোন করব।
বাবা, তোমার ঐ আধ্যাত্মিক ক্ষমতাধর মেয়ের বিষয়ে একটা কথা জানতে চাচ্ছি। তোমার রাগ একটু কমিয়ে প্রশ্নের জবাব দাও।