একটা কথা বলব আফা? ভূতটার কথা।
ভূতের আলাপ তো শেষ। আবার কেন?
আফা ভূতটারে কি আপনেও দেখতেন? আপনার পায়ে ধরি আফা বলেন।
রূপা বলল, ঘুমাতে যাও। কথায় কথায় পায়ে ধরার কিছু নেই।
মদিনা ঘুমুতে গেছে। রূপা দাঁড়িয়ে আছে জানালার পাশে। সে হাত বাড়িয়ে বাতি নিভিয়ে দিল। স্ট্রিট লাইটের সামান্য আলো আসছে। ঘর অন্ধকার করায় বৃষ্টি দেখা যাচ্ছে।
রূপা নিজের মনে বলছে–
কবে বিষ্টি পড়েছিল, বান এলো সে কোথা–
শিব ঠাকুরের বিয়ে হল কবেকার সে কথা!
সেদিনও কি এমনিতরো মেঘের ঘটাখানা!
থেকে থেকে বাজ-বিজুলি দিচ্ছিল কি হানা।
তিন কন্যে বিয়ে করে কী হল তার শেষে!
না জানি কোন্ নদীর ধারে, না জানি কোন্ দেশে,
কোন্ ছেলেরে ঘুম পাড়াতে কে গাহিল গান–
বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর, নদেয় এল বান।
রবীন্দ্রনাথের এই কবিতাটা রূপার মুখস্ত। মার কাছ থেকে শুনে শুনে রূপার পুরো কবিতা মুখস্ত হয়ে গেছে। তবে শায়লা কবিতাটা সামান্য বদলে আবৃত্তি করতেন। কোন ছেলেরে ঘুম পাড়াতে কে গাহিল গানের জায়গায় বলতেন, কোন মেয়েরে ঘুম পাড়াতে কে গাহিল গান।
সব সন্তানই বাবা-মার কাছ থেকে অনেক কিছু ধার করে। রূপা ঠিক করে রেখেছে সে তার মার কাছ থেকে কবিতা বলে ঘুম পাড়ানোর অংশটা ধার করবে। তার বাচ্চাদের ঘুম পাড়াতে সবদিন কবিতা আবৃত্তি করবে না। যেদিন ঝড়বৃষ্টি হবে সেদিন।
আফা!
এখনো ঘুমাও নি।
মন খুব অস্থির আফা।
রূপা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, মন অস্থির হবার মতো কিছু ঘটে নি। ঠিক আছে তোমার মন শান্ত করার ব্যবস্থা করছি। তুমি যে ভূতটাকে দেখতে আমিও দেখতাম। সুলতান চাচাকে একদিন বলেছিলাম। সুলতান চাচা বলেছিলেন, আরেকবার এই ধরনের কথা বললে থাপ্পড় খাবি। এরপর থেকে কাউকে বলিনি। ধরে নিয়েছিলাম, আমার নিজের কোনো সমস্যা।
আফা আপনারাও কি আমার মতো কোনো অসুখ?
হতে পারে।
মদিনা ফিসফিস করে বলল, রাশেদ ভাইজানের সঙ্গে আপনার যে বিবাহ হবে আপনি কি জানেন আফা?
জানি।
কবে জেনেছেন?
যেদিন তাকে প্রথম দেখি সেদিনই জেনেছি।
ত্যাগেই সব জানা কি ভাল আফা?
না ভাল না। হিসেব এলোমেলো হয়ে যায়।
উনি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে এটা কি বুঝেছিলেন?
হ্যাঁ। বুঝেও না বুঝার ভান করেছি। আমি স্বাভাবিক মেয়ে হতে চেয়েছি। মদিনা! মেঝেতে শোবার দরকার নেই। এসো খাটে এসে শোও। তুমি বিশেষ এক ক্ষমতা নিয়ে পৃথিবীতে এসেছ। আমিও এসেছি। এই ক্ষমতার উৎস যদি ব্রেইনের টিউমার হয় তাহলে এই জিনিস আমারও আছে। এসো খাটে আস।
মদিনা বিনাবাক্য ব্যয়ে খাটে উঠে এল। ক্ষীণ স্বরে প্রায় ফিসফিস করে বলল, আপনার খুব তাড়াতাড়ি রাশেদ ভাইজানের কাছে যাওয়া দরকার।
রূপা বলল, আমি জানি। আর কোনো কথা না। ঘুমাতে চেষ্টা কর। ঘুম এলে বৃষ্টির শব্দ শোন।
মদিনা জেগে আছে, বৃষ্টির শব্দ শুনছে। সে ঠিক করে রেখেছে রূপা আপা ঘুমুতে এলে সে একটা হাত আপার গায়ে রাখবে। আপা নিশ্চয়ই কিছু বলবে না।
তিন দিন হল রাশেদ উকিল বাড়িতে আছে
তিন দিন হল রাশেদ উকিল বাড়িতে আছে। একতলা পাকা দালান। বাড়ির পেছনে পুকুর। চারদিকে জঙ্গল। একসময় পুকুরের ঘাট বাঁধানো ছিল। এখন ভেঙে পড়েছে।
মূল বাড়িও ভেঙেছে। কোথাও কোথাও দেয়াল ধসে পড়েছে। ছাদের অবস্থা ভয়াবহ। বৃষ্টি হলেই ছাদ চুইয়ে পানি পড়ে।
একটা ঘর মোটামুটি ঠিক আছে। তবে দরজা নেই। রাশেদ চৌকি কিনে সেখানেই বিছানা পেতেছে। বিছানা বলতে শীতল পাটি, একটা বালিশ। সে হারিকেন কিনেছে দুটা। একটা দিন-রাত সারাক্ষণই তার চৌকির নিচে জ্বালিয়ে রাখে। যেন ঘরে সাপ আসতে না পারে। রাশেদের ধারণা বাড়িভর্তি সাপ। ইটের ভাঙ্গাবাড়ি সাপদের বাসস্থানের জন্যে আদর্শ। তবে সে যেহেতু সাপদের বিরক্ত করছে না। সাপরাও সম্ভবত তাকে বিরক্ত করবে না।
বাড়ির দারা ঠিক আছে। ইদারা তেমন ভাঙে নি। ইদারার পানিও ভাল। ইদারার বাঁধানো অংশে বসে থাকতে রাশেদের ভাল লাগে। তার বাবা যখন বাড়ি থাকতেন বেশির ভাগ সময় এই জায়গায় বসে থাকতেন। মন ভাল থাকলে রাশেদের সঙ্গে গল্প করতেন, ও বাবা রাশেদ! আমার দাদা অর্থাৎ তোমার বড় বাবা জ্বীন সাধক ছিলেন এটা জান?
না।
তাঁর পালা একটা জ্বীনের মৃত্যু হয়েছিল। দাদাজান মানুষের মতো তারে কবর দেন।
কোথায়?
বাড়ির পেছনে যে জঙ্গল আছে, সেইখানে পাকা কবর আছে। কবরের গায়ে আরবিতে লেখা তালিব। মনে হয় এইটাই জ্বীনের নাম। কবর দেখতে চাইলে একদিন নিয়া যাব। অজু করে যেতে হয়। যেতে চাও?
চাই।
আচ্ছা একদিন নিয়া যাক। এই জ্বীন দাদাজানরে টাকা-পয়সা আইন্যা দেয়। তিনি পাকা ঘর তুলেন। শুনেছি ঘর তুলতেও জ্বীন সাহায্য করেছে।
এইসব কি সত্য বাবা?
জানি না।
রাশেদ এসেছে শুনে তার দূর সম্পর্কের চাচা হাকিম উদ্দিন দ্বিতীয় রাতে হ্যাজাক লাইট জ্বালিয়ে দেখা করতে এসেছেন। ধমক দিয়ে বলেছেন, ভাইস্তা ব্যাটা তোমার কি মাথা খারাপ হইছে? চল আমার সাথে আমার বাড়িত থাকবা। এইখানে থাকলে সাপে কাটব। বাড়িভর্তি সাপ। গত বিষুদবারে এই বাড়ির উঠানে সাপে কাটছে।
রাশেদ বলল, ব্যবস্থা নিয়েছি চাচা। কার্বলিক এসিড দিয়েছি। দুটা হারিকেন সারারাত জ্বলে। মশারি কিনেছি, রাতে মশারি খাটিয়ে ঘুমাই। এই বাড়িতে থাকা আমার জন্যে বিশেষ প্রয়োজন।
প্রয়োজনটা কি?
আমি একটা মিরাকলের জন্যে অপেক্ষা করছি। এই বাড়িতে থাকলেই মিরাকলটা ঘটবে। অন্য কোধাও থাকলে ঘটাবে না।