রূপা বলল, শাস্তি দিলে দিবেন। এক্ষুণি ডাক। উনি ভুল বাড়িতে এসেছেন।
কি কন আপা?
ডেকে তোল। তোমাকে যে চকলেটের প্যাকেট দিয়েছে সেটা ফিরত দাও।
মলিনা বলল, সর্বনাশ প্যাকেট খুইল্যা তিনটা চকলেট খায়া ফেলছি। খেয়ে ফেলেছ ভাল করেছ। এখন উনাকে ডেকে তোল।
মলিনা চিন্তিত মুখে গেস্টরুমে ঢুকল। পেছনে পেছনে গেল রূপা। রাশেদ মরার মতো ঘুমাচ্ছে। অনেক ডাকাডাকির পর চোখ খুলল। তার চোখ টকটকে লাল। দৃষ্টি এলোমেলো। রূপা বলল, আপনি ঠিকানা ভুল করেছেন। বাবা আপনাকে চেনেন না। তার সঙ্গে আপনার কথাও হয় নি। তিনি একজন রাশেদকেই চেনেন যার একটা চোখ নষ্ট। সবাই তাকে ডাকে কানা রাশেদ।
ও আচ্ছা।
রূপা বলল, আমি দারোয়ানকে বলছি সে একটা সিএনজি এনে দেবে। আপনি সিএনজি নিয়ে চলে যাবেন।
সিএনজি কি?
সিএনজি হল ইয়েলো ক্যাব। গ্যাসে চলে। Concentrated Natural Gas, CNG.
ও আচ্ছা।
ও আচ্ছা বলেই রাশেদ আবার বিছানায় শুয়ে চোখ বুজল। মলিনা বলল, আফা উনারে জাগানি অসম্ভব। দেখেন না কি ঘুম ঘুমাইতাছে।
রূপা বলল, কিছুক্ষণ পর আবার ডাক।
রাইতে খাওয়ার সময় ডাকি আফা? খাওয়া দাওয়া কইরা চইলা যাবে। জিগাইতেছিল রাইতে রান্ধা কি? বিদেশ থাকে। দেশি খানা খায় না। আমি বললাম, মুরগির সালুন করেছি, বেগুন ভর্তা, আলু ভর্তা, মাষের ডাল, সরপুঁটি ভাজি।
মলিনা কথা বন্ধ। আরেকবার ডাক।
মলিনা কিছুক্ষণ ডাকাডাকি করল। রাশেদ চোখ মেলে আবারও চোখ বন্ধ করল। মলিনা বলল, ভাইজানরে এখন হাতি দিয়া টাইন্যাও তুলতে পারবেন না।
এর মধ্যে ভাইজান পাতিয়ে ফেলেছ?
আমি তো উনারে রাশেদ বইল্যা ডাক পাড়তে পারি না। ভাইজান ছাড়া উপায় কি?
তুমি যেভাবেই পার তোমার ভাইজানকে ডেকে তোল। প্রয়োজনে গায়ে এক বালতি পানি ঢেলে দাও।
দশটা মিনিট পরে পানি ঢালি আপা? আরামের ঘুম দিছে মায়া লাগে। ঘুমন্ত মানুষরে জোর কইরা তুলতে নাই। যে তোলে তার শইল কাঁপানি রোগ হয়।
শইল কাঁপানি রোগ কি?
ঘুমের মধ্যে শইলে ঝুঁকির মতো হয়।
অদ্ভুত অদ্ভুত কথা কোথায় পাও?
মলিনা বলল, আপনি আপনার ঘরে যান। এক ঘণ্টা পরে আসেন দেখবেন সব কিলিয়ার। আমি নিজে সিএনজিতে তুইল্যা বলব–ভাগ।
একটু আগে বলেছ দশ মিনিট। এখন বলছ এক ঘণ্টা।
হাতে কিছু সময় রাইখা বলছি। উনার জিনিসপত্র গুছাইতেও সময় লাগব। দেখেন কি করছে, দুইটা সুটকেসের সব জিনিস বাইর করছে। ঐ যে হইলদা জিনিসটা দেখতেছেন, এইটা মিথ্যা যন্ত্র। এই যন্ত্রে মিথ্যা বললে ধরা খাইতে হয়। লাল বাতি জ্বলে। পিপ পিপ শব্দ হয়।
রূপা বলল, উনি আমাকে এক প্যাকেট চকলেট অরি ভয়েস রেকর্ডার দিয়েছেন। তোমাকে দিচ্ছি তুমি উনাকে ফেরত দেবে। আমি নিজের ঘরে এক ঘণ্টা থাকব। এর মধ্যে তুমি সব ব্যবস্থা করবে। যাবার সময় উনি যদি আমার সঙ্গে দেখা করতে চান, তুমি বলবে আপার জ্বর এসেছে। আপা দরজা বন্ধ করে শুয়ে আছেন।
মিথ্যা কথা বলব? উনি যন্ত্রপাতি নিয়া আসছে। মিথ্যা বললে কোন বিপদ জানি হয়।
রূপা জবাব না দিয়ে দোতলায় উঠে গেল। এখানে যতক্ষণ থাকবে মলিনার বকবকানি শুনতে হবে। মেয়েটা নন-স্টপ কথা বলতে পারে। রূপার ধারণা সুযোগ দিলেই মলিনা এক নাগারে কথা বলার একটা বিশ্ব রেকর্ড করে গিনিজ বুকে নাম তুলে ফেলতে পারে। বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত পরিবারের কাজের মেয়ে বলে সুযোগটা সে পাচ্ছে না।
দোতলায় রূপাদের তিনটা কামরা। একটায় তার বাবা থাকেন। সেটা সবচে ছোট। বড় ঘরে তার নাকি ফাপড় লাগে। ঘুম ভাঙলে মনে হয় মাঠে শুয়ে আছেন। তার ধারণী শোবার ঘর এমন হবে যে বিছানায় শুয়ে সবকিছু হাতের নাগালে পাওয়া যাবে। বুকশেলফ, টেবিল, ওয়ারড্রোব সব থাকবে বিছানার সঙ্গে লাগানো।
দোতলার বিশাল সাইজের দুটা ঘরই রূপার। একটাকে রূপা ছবি আঁকার স্টুডিও বানিয়েছে। এই ঘরের ছোট দুটা জানালা ভেঙে বড় একটা জানালা করা হয়েছে। ঘরে প্রচুর আলো আসে। এই ঘরের সঙ্গে টেরাসের মতো আছে। টেরাসে সুন্দর বাগান। এক কোনায় বিশাল চৌবাচ্চা বানানো হয়েছে হারুন সাহেবের উৎসাহে। সেখানে দেশী মাছ ছাড়া হয়েছে, শিং, মাগুর, কৈ, তেলাপিয়া মাছগুলি আনন্দে আছে। হারুন চৌবাচ্চা আরো বড় করে সেখানে গলদা চিংড়ি চাষের চেষ্টা করার ইচ্ছা প্রকাশ করছেন। রূপা রাজি হচ্ছে না। সে বলেছে বাড়ির ছাদে পুকুর বানানোর কিছু নেই। ছাদ হচ্ছে সুন্দর বেড়ানোর একটা জায়গা। সেখানে মাছ চাষ করতে হবে কেন?
হারুন বলেছেন, মাছ কি অসুন্দর?
মাছ অসুন্দর না। চৌবাচ্চা থেকে ছিপ দিয়ে তোমার মাছ ধরাটা অসুন্দর।
অসুন্দরকে বাদ দিয়ে সুন্দর হয়? বাবা তোমার সঙ্গে আমি বাজে তর্কে যাব না। যাবি না কেন?
কোনো একটা তর্কে গেলেই তুমি টিচার ভাব ধরে ফেল। ক্লাসে বক্তৃতা দিচ্ছ এরকম ভঙ্গি। আর আমি যেন তোমার ছাত্রী। তাও বুদ্ধিমান কোনো ছাত্রী না। বোকা ছাত্রী।
রূপা যদিও বলে মাছের চৌবাচ্চা তার খুব অপছন্দ, ঘটনা তা না। সে চৌবাচ্চার পাশে বসে মাছ দেখে অনেকটা সময় কাটায়। গত মাসে মাছের একটা জল-রঙ ছবি এঁকেছে। ছবিতে একটা ড়ুবন্ত মাছের গায়ে আলো পড়েছে। ছবির নাম–জনে মীন রাশি। পুরো ছবিতে একটাই রঙ ব্যবহার করা হয়েছে। নীল রঙের নানান শেড।
হারুন ছবি দেখে বলেছেন, নামের অর্থ কি? জন্মে মীন রাশি বলতে তুই কি বুঝাচ্ছিস?