রূপা মঙ্গলগ্রহে জোছনার ছবি আঁকছে। এই ছবি আঁকায় কোনো বন্ধন নেই। মাটির রঙ লাল করা যাবে। নীল করা যাবে। জোছনার খেলাও বন্ধনমুক্ত। রূপা যা ইচ্ছা করতে পারে।
মদিনা সামনেই বসা। ছবি আঁকা দেখছে। তার চোখে আগ্রহ নেই, অনাগ্রহও নেই। এক ধরনের নির্লিপ্ততা যা সচরাচর দেখা যায় না। মানুষের পক্ষে নির্লিপ্ত হওয়া কঠিন ব্যাপার। রূপা বলল, তোমার কি শরীর খারাপ?
মদিনা না সূচক মাথা নাড়ল।
মন খারাপ?
মদিনা আবারও না সূচক মাথা নাড়ল। রূপা বলল, আমি তোমার বাবাকে একটা চিঠি লিখব। আমাকে ঠিকানা দিও।
মদিনা বলল, আমার বাবা লেখাপড়া জানেন না। মা জানে। চিঠি মারে লেখেন।
তার নাম কি?
সখিনা বিবি।
রূপী বলল, তোমার সম্পর্কে আমি প্রায় কিছুই জানি না। তোমরা কয় ভাইবোন?
চাইর ভইন। ভাই নাই। আমি সবচে ছোট। দুই ভইনের বিয়া হইছে। এক দুলাভাই রিকশা চালায় আরেক দুলাভাই ভ্যান চালায়।
তুমি যে মাঝে মাঝে অদ্ভুত কথা বল এই বিষয়ে তারা জানে?
জী জানে।
কিছু বলে তোমাকে?
না তারা থাকে পেটের ধান্দায়। পেট ছাড়া তারার অন্য চিন্তা নাই।
আমি যে ছবিটা আঁকছি সেটা কি ভাল হচ্ছে?
জী। জায়গাটা কোনখানে আফা?
মঙ্গল গ্রহ। সেখানে জোছনা ফুটেছে, তার ছবি।
এই রকম জায়গা সত্যই আছে?
রূপা বলল, পৃথিবীতেই এরচে সুন্দর সুন্দর জায়গা আছে। বিশ্বভ্রহ্মাণ্ড কত বিশাল! কি অদ্ভুত সব জিনিসই না সেখানে আছে।
রূপাকে হঠাৎ চমকে দিয়ে মদিনা সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রসঙ্গ তুলল। নীচু গলায় বলল, আফা! এই বাড়িতে যে একটা ভূত ছিল সেটা তো আপনে জানতেন।
রূপা বলল, ভূতের আলাপ থাকুক। আগেই বলেছি ভূতের আলাপ আমার পছন্দ না।
মদিনা এক দৃষ্টিতে রূপার দিকে তাকিয়ে আছে। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে সে কিছু বলতে চাচ্ছে। কিন্তু সাহস করে উঠতে পারছে না।
সন্ধ্যা নাগাদ ছবি আঁকা শেষ হল। রূপা নিজেই মুগ্ধ গলায় বলল, বাহ্!
মদিনা বলল, ছবিটা খুবই সুন্দর হইছে আফা। আমার জায়গাটায় যাইতে ইচ্ছা করে। ঐ দেশে দুইটা চান?
রূপা বলল, হ্যাঁ। একটার নাম ডিমোস আরেকটার নাম ফিবোস। এখন আমার জন্যে কাগজ আর কলম আন। আমি তোমার মাকে চিঠি লিখব। তোমার মার নাম সখিনা বিবি। ঠিক বলেছি না?
জী।
সখিনা বিবিকে লেখা রূপার চিঠি।
সখিনা বিবি।
আপনি কেমন আছেন? আমার নাম রূপা। আপনার মেয়ে মদিনা, আমার সঙ্গেই থাকে। নানান ভাবে আমাকে সাহায্য করে। সে খুব ভাল মেয়ে।
এখন আপনাকে একটা দুঃসংবাদ দিচ্ছি। মদিনার খারাপ একটা অসুখ ধরা পড়েছে। ব্রেইন টিউমার। ডাক্তাররা বলেছেন দ্রুত অপারেশন করে টিউমার দূর করতে। এতেই যে রোগ সারবে তা-না। দীর্ঘদিন কেমোথেরাপি রেডিও থেরাপি নামক চিকিৎসা চালাতে হবে। এতে প্রচুর টাকা-পয়সা লাগবে। আমাদের এত টাকা-পয়সা নেই। তারপরেও আমি চেষ্টা চালিয়ে যাব।
আপনার মেয়ে অপারেশনের ভেতর দিয়ে যেতে রাজি না। আমি তাকে আপনাদের কাছে পাঠাচ্ছি। আপনি এবং আপনার স্বামী তাকে রাজি করাবেন। সে আপনাদের সঙ্গেই থাকবে। অপারেশনের ব্যবস্থা করাতে পারলেই আমি তাকে নিয়ে আসব। আপনারা ভাল থাকবেন।
রূপা।
প্রতি সপ্তাহের সোমবারে রাত নটা থেকে দশটার মধ্যে শায়লা রূপাকে টেলিফোন করেন এবং দীর্ঘ সময় কথা বলেন। রূপা যতই বলে, আমার কাজ আছে বা ঘুম পাচ্ছে তাতে লাভ হয় না। শায়লা কথা বলতেই থাকেন।
দীর্ঘ কথোপকথনের জন্যে শায়লা এই দিন বেছে নিয়েছেন তার কারণ এই দিনে রাত আটটা থেকে মধ্য রাত পর্যন্ত তার স্বামী তার এক বন্ধুর বাড়িতে হাইড্রোজেন নামের জুয়া খেলতে যান। ভদ্রলোকের জুয়ার ভাগ্য সর্বনিম্ন পর্যায়ের। তিনি প্রতিবারই হারেন। মধ্যরাত পার করে বাড়ি ফেরেন। তখন তার শারীরিক অবস্থা এমন থাকে যে গাড়ির ড্রাইভার এবং বাড়ির মালী দুজন মিলে ধরাধরি করে তাকে লিফটে তুলে। তিনি যেন লিফটে বমি না করেন তার জন্যে মুখের কাছে পলিথিনের একটা ব্যাগ ধরে রাখা হয়।
রাত নটা দশ। শায়লা তার মেয়েকে টেলিফোন করেছেন। নিতান্ত অনিচ্ছায় রূপা টেলিফোন ধরল।
কেমন আছিস রূপা?
ভাল।
তোর বাবা যে পাত্রী চেয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল তার ফলাফল কি?
প্রচুর জবাব এসেছে। যাচাই বাছাই হচ্ছে।
যাচাই বাছাই কে করছে?
আমি করছি। সুলতান চাচা করছেন। দুই সদস্যের একটা কমিটি তৈরি করা হয়েছে। মা তুমি কি এই কমিটিতে থাকতে চাও?
আমি থাকব কোন দুঃখে?
বাবার ভাল-মন্দতো তুমি সবচে ভাল জান। তোমার পক্ষেই সম্ভব সেই মেয়ে খুঁজে বের করা যে বাবার জন্যে পারফেক্ট।
শায়লা বললেন, আমি লক্ষ্য করেছি যেসব কথায় আমি হার্ট হই, অপমানিত বোধ করি, তুই আমাকে সেইসব কথাই বলিস। এই জন্যেই তোর সঙ্গে আমি কথা বলতে চাই না।
রূপা বলল, তাহলে মা টেলিফোন রাখি। আমার নিজেরও কাজ আছে। সুলতান চাচা আজ আমাদের বাড়িতে থাকবেন। তিনি রাই সরিষা বাটা দিয়ে মুরগির মাংস খেতে চাচ্ছেন। আমাকেই না-কি রাঁধতে হবে।
শায়লা বললেন, জরুরি একটা কথা বলার জন্যে তোকে টেলিফোন করেছি। কথা শেষ হোক তারপর রাই সরিষা দিয়ে মুরগি রাধবি।
বল।
তোর বাবা যে আমাদের ম্যারেজ ডের ক্যান্ডেল লাইট ডিনার নষ্ট করেছে সেটা তো তোকে বলেছি।
হ্যাঁ বলেছ।
আমার জন্যে হয়েছে শাপে বর! কীভাবে জানতে চাস?
জানতে চাই না, তারপরেও তুমি জানাতে চাইলে বল। আমি শুনছি। অল্প কথায় শেষ করবে মা। মলিনার মত উপন্যাস পাঠ শুরু করবে না।