রূপা! আমি জানি না।
রূপা আবারও চমকালো। মানুষটা এত সহজে তাকে রূপা ডাকল কেন?
রূপা ব্যানার্জির কারণে? ডেকে ডেকে অভ্যাস?
বাড়ির নাম মঞ্জুরী।
চারতলা বাড়ি। গেটে বাগান বিলাসের ঝাড়। গেটের দারোয়ান রাশেদকে ঢুকতে দিচ্ছে না। দারোয়ান রাশেদের কথা জানিয়ে ইন্টারকম করেছিল। বাড়ির মালিক দেওয়ান সাহেব বলেছেন, গেস্টকে বল সকালে আসতে। আমার শরীর ভাল না, জ্বর।
রাশেদ বলল, উনার সঙ্গে কথা না বললেও চলবে। তার মেয়ে রুনার সঙ্গে কথা বলব।
দারোয়ান বলল, আপনি অপেক্ষা করেন আপার সাথে কথা বলে দেখি।
রাশেদ অপেক্ষা করছে। রাতের আকাশে মেঘ। ঘন ঘন বিজলি চমকাচ্ছে। আজ বৃষ্টি নামলে ভেজা যাবে না। আবার হাসপাতাল। আবার দুঃস্বপ্ন।
গেট খুলছে। দারোয়ান বলল, গাড়ি ভেতরে ঢুকবে না।
রাশেদ বলল, আমি যে ঢুকতে পারছি এতেই খুশি।
রাশেদ বসার ঘরে অপেক্ষা করছে। ঘরের সাজসজ্জা খানিকটা উগ্র। একটার সঙ্গে আরেকটার মিল নেই। পাথরের অর্ধ নগ্ন নারীমূর্তির পাশে থালাভর্তি প্রাস্টিকের ফলমূল। দেয়ালে কামরুল হাসানের পেইনটিং আছে। অতি কুৎসিত ফ্রেমে চমৎকার একটা ছবি। সমুদ্রে পানি হাঁটু পর্যন্ত ড়ুবানো একটা মেয়ের ছবি আছে। এই মেয়েটা রুনা। রুনার অনেকগুলি ছবি রাশেদের কাছে। মেয়েটার মুখ শান্ত। চোখে স্বপ্ন আছে।
রুনার বাবা দেওয়ান সাহেব ঢুকলেন। রাশেদ উঠে দাঁড়াল।
তুমি রাশেদ?
জী।
ছবিতে দেখেছি। হকির চেহারা এবং সামনা-সামনি চেহারা এক না। বসো।
রাশেদ বসলো। তার কাছে দৈওয়ান সাহেবকে মোটেই অসুস্থ মনে হচ্ছে। তবে ভয়ংকর বিরক্ত মনে হচ্ছে। দেওয়ান সাহেব সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, আমরা একটা ভুল করে ফেলেছি কাটা আর বাড়াতে চাচ্ছি না। তোমাকে আগেই জানানো হয়েছে। তারপরেও কেন এসেছ বুঝলাম না। দ্য গেম ইজ ওভার।
রাশেদ বলল, আমি রুনার সঙ্গে পাঁচ মিনিট কথা বলে চলে যেতাম।
তার সঙ্গে কি কথা বলবে। সে ভয়ংকর আপসেট। টেলিফোনে বিয়েতে সে শুরু থেকে রাজি ছিল না। আমিও ছিলাম না। কু-পরামর্শে কাজটা করেছি। ছেলে রাজপুত্র, PhD, ইউনিভার্সিটিতে পড়ায়। What a shame.
রাশেদ চুপ করে আছে। ভদ্রলোক প্রচণ্ড রেগেছেন। হাতের সিগারেটে দুটা টান দিয়ে ফেলে দিয়ে নতুন সিগারেট ধরিয়েছেন। ভদ্রলোকের রাগ কমার আগে কথা বলা অর্থহীন।
রাশেদ শোন, তুমি রসগোল্লা পান্তুয়া যাই হও না কেন, তুমি মূলত স্ট্রিট বয়। ভুল বললাম, তার চেয়েও খারাপ। তোমাকে ডাস্টবিনে পাওয়া গেছে। সারারাত ডাস্টবিনে পড়েছিলে। তোমার ফুসফুস এই কারণেই নষ্ট।
রাশেদ বলল, কথাগুলি আপনাকে যে জানিয়েছে সে ভুল জানিয়েছে। এটা আপনাকে আগেও বলেছি, এখনো বলছি।
তুমি কি অস্বীকার কর যে তোমার লাংস নষ্ট না?
লাংস ক্ষতিগ্রস্ত এটা ঠিক আছে। পরের কথাগুলি ঠিক না।
রূপা ব্যানার্জি নামে যে মেয়েটার সঙ্গে তুমি লিভ টুগেদার করতে এটাও ভুল?
জী ভুল।
বাঙালি মেয়ে না?
হ্যাঁ, কোলকাতার মেয়ে।
একটা বাঙালি মেয়ে জেনেশুনে এত বড় অপবাদ মাথায় নিয়ে বলবে সে তোমার সঙ্গে লিভ টুগেদার করত এবং তোমাদের একটা মেয়ে আছে তিন বছর বয়স। তার নাম নিহি।
রাশেদ বলল, আপনি অত্যন্ত উত্তেজিত অবস্থায় আছেন। তিন মিনিটে চারটা সিগারেট ধরিয়েছেন। একজন উত্তেজিত মানুষকে কিছু বোঝানো যায় না। আপনাকে বোঝাতেও চাচ্ছি না।
দেওয়ান সাহেব বললেন, আমার কথা শেষ হয় নি। কথা শেষ হোক তারপর ফড়ফড় করবে।
অবশ্যই। কথা শেষ করুন।
টেলিফোনের বিয়ে কোনো বিয়ে না। এর আইনগত কোনো ভেলিডিটি নেই। আমরা এই বিয়ে স্বীকার করছি না।
রাশেদ বলল, কোনো সমস্যা নেই। আমি বিয়ে বজায় রাখার চেষ্টা করতে আসি নি।
তাহলে কি জন্যে এসেছ?
রুনা আমাকে জঘন্য একজন মানুষ ভাবছে এটাই খারাপ লাগছে। আমি নিশ্চিত সে চমৎকার কোনো ছেলেকে বিয়ে করে সুখে জীবন কাটাবে। তবে কখনো কখনো তার মনে হবে টেলিফোনে বিয়ে করে কি ভুলই না করেছিলাম। প্রথম স্বামী ছিল ভয়ংকর। এটা তাকে কষ্ট দিবে। আমি তাকে কষ্ট থেকে মুক্তি দিতে চেয়েছিলাম। সে যদি জানে তার প্রথম স্বামী খারাপ মানুষ ছিলেন তাহলে তার কষ্ট কম হবে।
প্রথম স্বামী, প্রথম স্বামী করছ কেন? তোমার সঙ্গে কি রুনার বিয়ে হয়েছে? টেলিফোনে বকর বকর করা মানে বিয়ে না। তোমরা এখনো চাক্ষুষ কেউ কাউকে দেখনি। যাই হোক আমার কথা শেষ। এখন বিদেয় হও। ফর ইওর ইনফরমেশন, এই মাসের আঠারো তারিখ আমার মেয়ের বিয়ে হচ্ছে। জামাই লেফটেনেন্ট কর্নেল।
রাশেদ বলল, আমি কি তাকে বিয়ে উপলক্ষে একটা গিফট দিতে পারি।
তুমি গিফট দেবে কেন? তুমি কে?
রুনার কাছে আমি একবার জানতে চেয়েছিলাম দেশে যখন আসব তখন তোমার জন্যে কি আনব? সে বলেছিল একটা লাই ডিটেক্টর আনতে। তার এক বান্ধবীর আছে। সবাই এটা নিয়ে মজা করে। আমি একটা লাই ডিটেক্টর তার জন্যে এনেছি। খেলনা ভার্সান। গাড়িতে আছে। নামিয়ে দিয়ে যাই?
তুমি লাই ডিটেক্টর নিয়ে বিদায় হও। এই ডিটেক্টরে নিজের মিথ্যাগুলি ধরার চেষ্টা কর। ভুল ইনফরমেশন দিয়ে বিয়ে করার জন্যে আমি যে তোমাকে পুলিশে দিতে পারি এটা জান? পুলিশের এডিশনাল আইজি রুনার বড় মামা।
রাশেদ উঠে দাঁড়াল। বৃষ্টি পড়া শুরু হয়েছে। সে হোটেলের সন্ধানে বের হবে, না চায়ের দোকানে রাতের জন্যে আশ্রয় নেবে তা বুঝতে পারছে না। আচ্ছা গাড়ি চলতে শুরু করুক তারপর চিন্তা করা যাবে। কমলাপুর রেল স্টেশনে গেলে কেমন হয়? রাতে যদি কোনো ট্রেন পাওয়া যায় সেই ট্রেনে করে নেত্রকোনা চলে যাওয়া। স্টেশনের নাম আঠারোবাড়ি। সে গ্রামের বাড়িতে উপস্থিত হল, আর একটা মিরাকল ঘটল। জগতে মিরাকল যে একেবারেই ঘটে না, তাও না। মাঝে মাঝে ঘটে। প্লেন ক্রাশ হয়েছে। প্লেনের দুশ আশিজন যাত্রীর সবাই মারা গেছে। একজন বেঁচে আছে, সতুর বছরের বৃদ্ধ। ব্যাংকের ক্যাশিয়ার। সংসারে কেউ নেই। বৃদ্ধ নিবাসে থাকে। মেয়েকে দেখতে গিয়েছিল। ফেরার পথে দুর্ঘটনা।