মদিনা না সূচক মাথা নাড়ল।
রাশেদ সাহেবকে দেখেছ?
হুঁ।
উনি মানুষ কেমন?
মানুষ কেমন আমি তো আফা বলতে পারি না।
মদিনা তোমার সঙ্গে আজ রাতে আমি আলাদা করে বসব। তোমাকে দেখে কেন জানি মনে হচ্ছে তুমি কিছু বলতে চাচ্ছ। বলতে পারছ না।
আফা চা খাবেন? চা আইন্যা দেই?
চা খাব না। বাবাকে ডেকে নিয়ে আস।
মদিনা বলল, আমি ছাদে যাব না আফা।
যাবে না কেন?
মদিনা চুপ করে রইল।
তুমি কি কোন কারণে রাশেদ সাহেবের সামনে যেতে চাচ্ছ না?
মদিনা এই প্রশ্নেরও জবাব দিল না। অন্যদিকে তাকিয়ে রইল।
হারুন তাঁর রহস্য খাতা খুলেছেন। রহস্যময় যেসব খবর পত্রিকায় ওঠে তিনি তার পেপার কাটিং জমা করেন।
হারুন রহস্য খাতা রাশেদের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, রাশেদ! এই ছেলেটাকে দেখ–বালক পীর। সপ্তাহে একদিন সন্ধ্যা থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত সে যাকে যা বলে তাই হয়। নাম ওসমান। বাবা দিনমজুর। আমি গিয়েছিলাম দেখতে। হাজার হাজার মানুষ। ভিড় ঠেলে এগুতে পারলাম না।
ব্যাপারটা কি আপনার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়?
আমার উত্তর হচ্ছে, হ্যাঁ এবং না। জগৎ রহস্যময় এটা তুমি মান, না-কি মান না?
রাশেদ বলল, আমার উত্তরও হ্যাঁ এবং না। একইসঙ্গে রহস্যময় আবার রহস্যময় না।
হারুন বললেন, আমার এখানে মদিনা নামের একটা মেয়ে আছে। তার নাম আমি দিয়েছি ঘড়ি-কন্যা। সে হল জীবন্ত ঘড়ি।
আপনার কথা বুঝতে পারছি না।
ধীরে ধীরে বুঝবে। একদিনে সব জেনে ফেললে হবে না। মেয়েটা সম্পর্কে রাজশাহীর দৈনিক প্রভাতে কি লিখেছে পড়ে দেখ, আমি আরেক দফা কফির কথা বলে আসি। না-কি চা খাবে?
আপনি যা খাবেন। তাই খাব।
টক দৈয়ের শরবত খাবে? টক দৈ, গোল মরিচ আর লবণ ব্লেন্ডারে দিয়ে বানানো হয়। সঙ্গে থাকে এক ফালি কাঁচামরিচ আর এক চিমটি ধনেপাতা। গ্রাসের উপর দুই ইঞ্চি পরিমাণ কুচি বরফ। এক চামচ চিনি।
শুনেই তো খেতে ইচ্ছা করছে।
সমস্যা একটাই, রূপা ছাড়া কেউ বানাতে পারে না। সে ফিরেছে কি-না কে জানে। দেখি ব্যবস্থা করি। হারুন ব্যস্ত ভঙ্গিতে নেমে গেলেন। তার এই ব্যস্ততা দেখার মতো।
বসার ঘরেই রূপাকে পাওয়া গেল। হারুন বললেন, দুটা টক দৈয়ের শরবত। কুইক।
রূপা বলল, বাবা বসো তো।
এখন বসতে পারব না। রাশেদের সঙ্গে অত্যন্ত জরুরি একটা আলাপ করছি। তুই শরবতটা বানিয়ে ছাদে পাঠানোর ব্যবস্থা কর।
শরবত বানানো যাবে না। ঘরে টক দৈ নেই।
ড্রাইভারকে পাঠা। নিয়ে আসবে।
রূপা বলল, বাবা! তুমি বসো। তোমার সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে। রাশেদ সাহেবের সঙ্গে আলাপের চেয়েও আমারটা জরুরি।
বল।
তুমি বস তারপর বলব।
তুই এত ঝামেলা করিস কেন? জরুরি কথা বসে শুনতে হবে? অতি জরুরি কথা শুয়ে শুনতে হবে? আচ্ছা যা বসলাম।
রূপা বলল, বাবা শোন। রাশেদ নামের মানুষটাকে আমরা কেউ চিনি। তার বিষয়ে কিছুই জানি না। তুমি প্রথম দেখাতেই তাকে কোলে নিয়ে বসে আছ এটা কি ঠিক হচ্ছে?
হারুন বললেন, কোনো একজন মানুষকে আমার পছন্দ হাতে পারবে না?
পাঁচ মিনিটের পরিচয়ে হতে পারবে না।
পঞ্চাশ বছরের পরিচয় লাগবে? তোর মার সঙ্গে এগারো বছরের পরিচয় ছিল। তাকে চিনতে পেরেছি?
বাবা! তুমি লজিক গোলমাল করে ফেলছ।
আমাকে লজিক শিখাবি না। স্টুপিড মেয়ে।
রেগে না গিয়ে আমার কথা মন দিয়ে শোন। তুমি উঁচু তারে বাধা একজন মানুষ। কাউকে অতি দ্রুত পছন্দ হওয়া এবং অতি দ্রুত অপছন্দ হওয়া তোমার চরিত্রের অংশ। এটা ঠিক না।
কাকে অতি দ্রুত অপছন্দ করলাম? সুলতান চাচাকে।
যে ছাগলা একটা কথা চারবার করে বলে তাকে অপছন্দ করতে পারব না?
তাঁর এই স্বভাবের পরেও তাঁর সঙ্গে তোমার গভীর বন্ধুত্ব ছিল। পরপর দুদিন না দেখলে তুমি অস্থির হয়ে যেতে।
মূল কথাটা বল। রাশেদের সঙ্গে আমি কথা বলতে পারব না। এইটাই তো মূল কথা?
মূল কথা হচ্ছে তোমার ভোলাটাইল নেচার চট করে অপরিচিত একজনকে দেখিও না। সে তোমার নেচার বুঝতে পারবে না। তোমাকে নিয়ে মনে মনে হাসবে। আমোদ পাবে। তোমার কর্মকাণ্ডে কেউ আমোদ পাবে এটা আমার পছন্দ না।
হারুন উঠে দাঁড়ালেন। কঠিন গলায় বললেন, তুই কি মনে করে অচেনা অজানা একজনকে বাড়িতে এনে তুলেছিস এটা বল। তুই নিজেই তো তাকে এ বাড়িতে কোলে করে এনেছিস। আমি আনি নি।
রূপা বলল, বাবা। উনি আমার উপর রাগ করে বাড়ি থেকে বের হয়ে ঝড়বৃষ্টিতে পড়ে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ছিলেন। আমি অপরাধ বোধ থেকে তাঁকে এ বাড়িতে এনেছি। তিনি সে রাতে ডিনার না করে চলে গিয়েছিলেন। আমি তাঁকে ডিনার করাব। তিনি যে ঠিকানায় যেতে গিয়ে ভুল করে আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন আমি নিজে তাকে সেই ঠিকানায় পৌঁছে দেব। রাতে ডিনারের পরপর এই কাজটা করা হবে।
এত দেরি করে লাভ কি? এখনি লাথি দিয়ে বের করে দে। যেখানের জিনিস সেখানে চলে যাবে।
বাবা। তুমি আবার ছেলেমানুষি শুরু করেছ।
হারুন বললেন, আমি ছেলেমানুষ তাই ছেলেমানুষি করছি। তুই বুড়ি, তুই করবি বুড়ি মানুষী। যা আমি তার সঙ্গে বাস করব না।
কোথায় যাবে?
বনে জঙ্গলে চলে যাব। গাছের ডালে ঝুলে থাকব। ক্ষুধা লাগলে গাছের পাতা খাব।
হারুন হন হন করে সদর দরজা খুলে রাস্তায় নেমে গেলেন।
রূপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাতের ডিনারের আয়োজন করতে গেল। রাশেদ নামের মানুষটার পরোটা মাংস খেতে মন চাইছে। ঝাল মাংস সঙ্গে বিসকিটের মতো পরোটা।