রাশেদ অবাক হয়ে বলল, মলিনা তো আমাকে দরজা খোলার সময় বলেছে উনি রাজশাহী গেছেন।
রূপা বলল, রাজশাহীর মানুষের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলা যায়। বাংলাদেশের টেলিফোন সার্ভিস যথেষ্ট উন্নত।
আরে তাই তো। সরি। রূপা দেখ তো এটা কি তোমার পছন্দ হয়?
জিনিসটা কি?
দেখতে অবিকল কলম। তাই না? আসলে ডিজিটাল ভয়েস রেকর্ডার। দশ ফুট দূরের শব্দও সে রেকর্ড করবে। নিখুঁত সাউন্ড! ব্যাকগ্রাউন্ড নয়েজ বাদ দেয়ার ব্যবস্থা আছে। নাও।
নিতান্ত অনিচ্ছায় রূপা হাত বাড়াল। নিতান্ত অপরিচিত কারো কাছ থেকে উপহার নেয়া যায় না। ভদ্রলোক তার বাবার পরিচিত। তাতে কি?
আরো অনেক ইন্টারেস্টিং জিনিস নিয়ে এসেছি। লাই ডিটেকটর। খেলনা ভাসান, তবে ভাল কাজ করে। মিথ্যা বললেই লাল বাতি জ্বলবে। পিপ পিপ শব্দ হবে। চা খেয়ে বের করে দিচ্ছি। তুমি তোমার বাবার সঙ্গে কথা বলে এসো।
রূপার বাবা হারুনুর রশিদ, একটা প্রাইভেট কলেজে ইতিহাস পড়াতেন। দুবছর হলো রিটায়ার করেছেন। অবসর জীবনে তার দুটা কাজ। বঙ্গ ইতিকথা নামে একটা ইতিহাসের বই লেখা এবং পীর ফকিরের অনুসন্ধানে যাওয়া। রূপার ধারণা পীর ফকিরের অনুসন্ধান তার একটা উপলক্ষ। তিনি ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করেন বলেই পীর ফকির। তাঁর মাথা সামান্য এলোমেলো। কারণ বঙ্গ ইতিকথা নামে যে বিশাল গ্রন্থ তিনি লিখছেন তার সবটাই কবিতার ছন্দে। সুলতানি আমলের লেখা এইভাবে শুরু করেছেন।
ছটফটে স্বভাব হলে ধৈর্য ধরুন
সুলতানি আমল কথা মন দিয়ে শুনুন।
১৩৪২ থেকে আমলে শুরু
শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহকে মানা যাক গুরু।
বখতিয়ার খিলজিতে পূর্ণ হয় নাম
সুলতানি আমল কথা শুরু করিলাম॥
হারুন এখন আছেন রাজশাহীর বিরামপুরে। সেখানে মদিনা নামের একজনকে পেয়েছেন। মদিনার প্যারানরমাল ক্ষমতা দেখে তিনি মুগ্ধ। হারুনুর রশিদ অতি দ্রুত মুগ্ধ হন আবার তারচেয়েও দ্রুততায় তাঁর মুগ্ধতা ভাঙে।
রূপার টেলিফোন পেয়ে তিনি প্রথম কথা যেটা বললেন, তা হল, রূপা। মাই ডটার। অনেক দিনের চেষ্টার পর জেনুইন জিনিস পেলাম। বাংলাদেশ হয়েছে ফ্রন্ডের আখড়া। সব নকল। এই প্রথম আসল পেয়েছি। ঘটনা শোন।
রূপা বলল, আগে আমার কথা শোন, তারপর তোমার আসল জিনিসের কথা শুনব।
না না শোন, আমি এত এক্সাইটেড যে আমি আমার পেটের কথা না বললে তোর কথা শুনতেই পারব না। মন বসবে না।
আচ্ছা বল।
রাজশাহীর একটা লোকাল নিউজ পেপারে প্রথম খবরটা পড়লাম। খবরের হেডিং–ঘড়ি-কন্যা। মূল বিষয়, ঘড়ি-কন্যা ঘড়ি না দেখে টাইম বলতে পারে। মনে কর কেউ গেল মদিনার কাছে। সে বলল, মদিনা! আমার ঘড়িতে কয়টা বাজে? মদিনা সঙ্গে সঙ্গে টাইম বলে দেবে। আমি চিন্তা করলাম মেয়েটার কাছে লুকানো ঘড়ি থাকতে পারে। হয়ত জামার আড়ালে এমনভাবে রাখী যে সে শুধু দেখতে পায়। অন্যরা পায় না। আমি করলাম কি নিজের ঘড়ি পঁয়তাল্লিশ মিনিট পিছিয়ে রাখলাম। মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলাম–সে হুবহু বলে দিল। এক মিনিট এদিক ওদিক হল না। অদ্ভুত না?
অদ্ভুত। প্যারানরমাল ক্ষমতা নিয়ে অনেক মানুষ জন্মায় আমরা তার খবর রাখি। এই নিয়ে বিখ্যাত কবিতা আছে
Full many a flower is born to blush unseen
And washed its sweetness in the desert air.
রূপা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, বাবা তোমার কথা মন দিয়ে শুনলাম। এখন আমার কথা শোন, রাশেদ সাহেব এসেছেন।
রাশেদ সাহেব কে?
জানি না কে।
আরে গর্দভ মেয়ে জিজ্ঞেস করবি না? আপনি কে? আপনার পরিচয় কি? কি করেন?
বাবা আমি কোর্টের উকিল না। জেরা করতে পারি না। ভদ্রলোক বলেছেন তুমি তাকে খুব ভাল করে চেন। বেশ কয়েকবার টেলিফোনে তার সঙ্গে তোমার কথা হয়েছে?
হারুন বললেন, রাশেদ নামের একজনকেই আমি চিনি। সে চিটাগাংয়ে থাকে। কাঠের দোকান আছে। চেড়াইকল আছে। কাঠের গুতা খেয়ে তার একটা চোখ নষ্ট হয়েছে বলে সবাই তাকে ডাকে কানা রাশেদ। আমেরিকার কোনো রাশেদের সঙ্গে আমার কথা হয় নাই।
বল কি?
আমার তো মনে হচ্ছে বাজে মতলব নিয়ে কেউ ঢুকেছে। ঢাকা শহরে এরকম আজকাল হচ্ছে। মিথ্যা পরিচয় দিয়ে ঢুকে সর্বনাশ করে চলে যাচ্ছে। খুন-খারাবি পর্যন্ত হচ্ছে। আজকের পেপারেই তো আছে। গাধা মেয়ে, খবরের কাগজ পড়িস না। ঘুম ভাঙ্গার পর প্রথম কাজ খবরের কাগজ পড়া।
তুই বুঝতে পারছিস না যে ভয়ঙ্কর কেউ ঢুকেছে?
আমার সেরকম মনে হচ্ছে না। আমার মনে হচ্ছে উনি ভুল করে এ বাড়িতে এসেছেন।
এক্ষুণি বিদায় কর।
উনি চা খাচ্ছেন। চা খাওয়া হোক তারপর বলব।
চা খাচ্ছে মানে কি? তাকে তো ঘরেই ঢুকতে দেয়া ঠিক হয় নাই। গেট থেকে বিদায় করে দেয়া উচিত ছিল। দারোয়ান একটাকে রেখেছি গাধার গাধা। কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করবে না। আন ওয়ান্টেড লোকজন কোলে করে এনে সোফায় বসিয়ে দিয়ে যাবে। আর তুইও এমনি অতিথিপরায়ণ, কিছু জিজ্ঞেস না করেই চা-কফি-কেক-পেস্ট্রি।
বাবা! তুমি উত্তেজিত হয়ো না। আমি ব্যবস্থা করছি।
ব্যবস্থা করাকরির কিছু নাই। তুই তাকে বলবি, আপনি ভুল ঠিকানায় এসেছেন। Now get fost. বিদায় হবার পর আমাকে টেলিফোনে জানাবি যে বিদেয় হয়েছে। আমি দুই রাকাত শুকরানা নামাজ পড়ব।
বসার ঘর ফাঁকা। মলিনার হাতে চায়ের ট্রে। সে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছে। রূপা বলল, উনি কোথায়?
মলিনা বলল, ঘুমাইতাছে! গেস্টরুম খুইল্যা দিলাম। সাথে সাথে বিছানায় শুইয়া ঘুম। আমারে বলেছেন খাওয়ার সময় ডাক দিতে। আগে ডাক দিলে আমার জন্যে শাস্তির ব্যবস্থা। কি শাস্তি দিব কে জানে। কি সুন্দর কইরা বলছে–ডাকলে শাস্তি।