তার নাম কি রাশেদ?
জী। রাশেদ রহমান। তিনি আমেরিকান এক ইউনিভার্সিটিতে অঙ্কের লেকচারার। মোরহেড স্টেট ইউনিভার্সিটি। আমি আজ চেষ্টা করব তাঁর ইউনিভার্সিটির সঙ্গে যোগাযোগ করতে।
আপনি ডাক্তার?
জী। আমার নাম রুবিনা।
রূপা বলল, রাশেদ সাহেবকে সেভাবে আমি চিনি না। তিনি ঠিকানা ভুল করে আমাদের বাড়িতে উঠেছিলেন। কিছুক্ষণ ছিলেন।
সরি। সরি।
সরি কেন হবেন? আপনি যে কাজটা করেছেন কতজন এটা করে? আমাকে পাঁচটা মিনিট সময় দিন। আমি আপনার সঙ্গেই যাব। এক কাপ চা দিতে বলি?
বলুন।
রাশেদ সাহেবের অবস্থা কতটা খারাপ?
বেশ খারাপ। সারভাইব নাও করতে পারেন। পরিচিত কেউ তার পাশে নেই। মানুষটা মারা যাচ্ছে। আমার খুব খারাপ লাগছিল।
রূপা স্যান্ডেল খুঁজছে। দরজার আড়াল থেকে দেখছে মদিনা। চোখে চোখ পড়তেই সে সরে গেল। রূপা বলল, মদিনা কাছে আস।
মদিনা ভীত মুখে সামনে এসে দাঁড়াল। যেন সে বড় কোনো অপরাধ করেছে। অপরাধের বিচার সভা বসেছে। অপরাধের কারণে তাঁর কঠিন শাস্তি হবে। রূপা বলল, আমি কোথায় যাচ্ছি তুমি জান?
মদিনা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল।
রূপা বলল, তুমি অত্যন্ত বিপজ্জনক এক মেয়ে। আগেভাগে সব জেনে ফেলছে। এটা ঠিক না। এতে আমাদের পরিকল্পনা এলোমেলো হয়ে যায়।
মদিনা বলল, আমারে মাফ করে দেন আফা।
মাফ দেয়ার মত কোনো অপরাধ তুমি করোনি, শুধু শুধু ভয় পাচ্ছ কেন?
মদিনা ভয় পাচ্ছে কারণ সে আরো একটা ঘটনা জানে। যে ঘটনা ঘটে নি কিন্তু ঘটবে। ঘটনাটা সে রূপাকে বলার সাহস করে উঠতে পারছে না।
নিজের উপর মাঝে মাঝে তার ভয়ংকর রাগ লাগে। সবাই এক রকম, সে আলাদা কেন? কেউ ভূত দেখে না সে কেন দেখে? এক শ্রাবণ মাসের দুপুরে সে যদি পুকুরের পাড়ে না যেত তাহলে হয়ত সে অন্য রকম হত না। স্বাভাবিক থাকতো।
তার যখন চার বছর বয়স সে স্কুল ঘরের সামনের দিঘিতে ড়ুবে গিয়েছিল। দিঘির পানি কি পরিস্কার! ড়ুবে যাবার পর মানুষ বাঁচার জন্যে ছটফট করে। সে কিছু করেনি। চোখ বড় বড় করে তাকিয়েছিল। হঠাৎ কি যেন ঘটল। সে অবাক হয়ে দেখলো তার মুখের উপর একটা মুখ। এমন এক নারীর মুখ যা দেখে শান্তিতে মন ভরে যায়। সেই অদ্ভুত নারী ফিসফিস করে বলল, যা তোকে জিনিস দিলাম। অনেক বড় জিনিস দিলাম।
ততক্ষণে স্কুলের ছেলেরা ছুটে এসেছে, ড্রিল মাস্টার লাফ দিয়ে পানিতে পড়লেন। মদিনাকে টেনে তুললেন।
কতদিন পার হয়েছে। মদিনার বয়স এখন এগারো। দিঘির পানির মেয়েটিকে মদিনা এখনো হঠাৎ হঠাৎ স্বপ্নে দেখে। মেয়েটি কোমল গলায় বলে, কি রে মনে আছে আমার কথা?
মদিনার খুব ইচ্ছা এই মেয়েটির কথা সে রূপা আপাকে বলে।
রূপী আপা রাগ করবেন। করলে করবেন। কাউকে তো বলতে হবে। তার যদি বড় ধরনের কোনো অসুখ হয়ে থাকে রূপা আপাই চিকিৎসা করবেন। তারা কত বড়লোক। তাদের তো আর টাকার অভাব নাই।
রূপা ডাকল, মদিনা।
মদিনা বলল, কি আপা।
তুমি কি আমার সঙ্গে হাসপাতালে যাবে? যদি যেতে চাও স্যান্ডেল পর।
মদিনার খুব যেতে ইচ্ছা করছিল। কিন্তু সে বলল, আফা আমি যাব না।
রূপা বলল, রাশেদ নামের মানুষটা সম্পর্কে তুমি কি আরো কিছু জান?
জানি। বলব?
না।
শায়লা মেয়েকে টেলিফোন করেছেন। রূপা বলল, একটু আগেই না তোমার সঙ্গে কথা হল।
শায়লা বললেন, একটু আগে কথা হলে এখন কথা বলা যাবে না?
না, যাবে না। আমি হাসপাতালে যাচ্ছি। হাসপাতাল থেকে ফিরে কথা হবে।
হাসপাতালে কেন?
এক ভদ্রলোক মারা যাচ্ছেন। মৃত্যুর আগে তিনি আমাকে গোপন কিছু কথা বলতে চান।
কি আশ্চর্য কথা, তার নাম কি? আমি কি যাব তোর সঙ্গে?
তুমি কেন যাবে? তার গোপন কথা শুনতে? অন্যের গোপন কথা তুমি কেন শুনবে?
রূপা টেলিফোনের লাইন কেটে দিল।
মদিনা ছাদে। চৌবাচ্চার পাশে বসে আছে। চৌবাচ্চার পানি স্কুল ঘরের সামনের দিঘির পানির মত পরিষ্কার। মদিনার ইচ্ছা করছে চৌবাচ্চার পানিতে শুয়ে তাকিয়ে থাকতে। পানির মেয়েটিকে অনেকদিন সে স্বপ্নে দেখে না। আজ খুব দেখতে ইচ্ছা করছে।
রাশেদ আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে
রাশেদ আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। তাঁর বাঁ পাশে ডিউটি ডাক্তারের চেয়ার টেবিল। দেয়ালে চারকোনা ঘড়ি। ঘড়ির সেকেন্ডের কাটা লাল। লাল কাটা লাফিয়ে লাফিয়ে যাচ্ছে। ঘড়িটাকে প্রাণশক্তিতে ভরপুর জীবন্ত প্রাণীর মতো লাগছে। সেই তুলনায় ডাক্তারকে সারা রাত জেগে থাকার কারণেই বোধহয় ক্লান্ত লাগছে। রাশেদ হাত উঁচু করল। ডাক্তার ছুটে এলেন। রাশেদের মনে হল ডাক্তারকে যতটা ক্লান্ত দেখাচ্ছিল তত ক্লান্ত তিনি না।
ডাক্তার রাশেদের পাশে এসে দাঁড়ালেন। রাশেদ বলল, আমি ভাল হয়ে গেছি। Good morning.
ডাক্তার কিছু না বলে রোগীর মাথার উপরের মনিটরের দিকে তাকালেন। তাঁকে খানিকটা বিস্মিত মনে হল। রাশেদ বলল, আমাকে অন্য কোনো ঘরে কি দেয়া যায়? যেখানে বড় জানালা আছে।
ডাক্তার জবাব না দিয়ে রোগীর পালস দেখলেন। তার প্রয়োজন ছিল। মনিটরে পালস রেট উঠছে। তিনি প্রেসার মাপলেন। রাশেদ বলল, দুটা পূর্ণ সংখ্যা গুণ করে ৭ বানাতে পারবেন? আপনাকে প্রশ্নটা করলাম বোঝানোর জন্যে যে আমার মেন্টাল ফেকাল্টি এখন ঠিক আছে। পূর্ণ সংখ্যা একটা হল ১ অন্যটা ৭, ১X ৭ = ৭।
এক ঘণ্টা আগেও তো আপনার ভয়ংকর খারাপ অবস্থা ছিল। সাড়ে দশটার দিকে আপনাকে আর্টিফিসিয়াল রেসপিরেটারে দেবার কথা। আমি খুবই অবাক হচ্ছি। স্যারকে খবর দিচ্ছি। স্যার এসে আপনাকে দেখুক। ভাল বোধ করছেন?