হুঁ।
তুমি যে মারা যাচ্ছ এটা বুঝতে পারছ?
হুঁ।
কি মজার কথা। মারা যাবার কথা ছিল আমার। আমি ঠিকই বেঁচে আছি। তুমি মরে যাচ্ছ।
হুঁ।
তোমার কবরে কি এপিটাফ হবে তুমি চিন্তা করেছ?
না।
আমি একটা বলব?
বল।
তোমার কবরে লেখা থাকবে–পাখি উড়ে গেছে।
আচ্ছা।
কালো গ্রানাইট পাথরে সাদা অক্ষরে লেখা। সেখানে উড়ন্ত একটা পাখির ছবিও থাকবে। তোমার কী পাখি পছন্দ?
ঘুঘু পাখি।
আচ্ছা ঠিক আছে–ঘুঘু পাখিই থাকবে। পাখিটার নিচে লেখা থাকবে। বার বার ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান। হি হি হি।
রূপা ব্যানার্জি শব্দ করে হাসছে। সে একা হাসছে না। আরো অনেকেই হাসছে। যারা হাসছে তারা কি সবাই ট্রেনের যাত্রী? ট্রেন থেমে আছে কেন?
রূপা ছবি নিয়ে বসেছে
রূপা ছবি নিয়ে বসেছে। লেমন ইয়েলোর প্রথম ওয়াশ দেয়া হয়েছে। রঙ শুকানোর পর দ্বিতীয় ওয়াশ। ওয়াটার কালার মানেই ম্যাজিক। প্রথম ওয়াশেই কিছু একটা ঘটে যেতে পারে। কাগজের বাম পাশে ঘূর্ণির মতো তৈরি হয়েছে সেখানে এক দানা লবণ ফেলে কি দেখবে কিছু হয় কি-না। কিংবা ড্রপার দিয়ে একফোঁটা নারকেল তেল ফেলে দেখা যেতে পারে। তেল পানিকে বিকর্ষণ করবে। হলুদ রঙের পানি সরিয়ে দেবে। রূপা চোখ বন্ধ করে ফেলল। কাগজ শুকানোর আগে সে চোখ খুলবে না। লবণ এবং নারকেল তেল আপাতত বাদ। বাইরের সাহায্য ছাড়াই যা হবার হোক। চোখ বন্ধ করে রঙের সঙ্গে কথা বলার খেলা এখন খেলা যেতে পারে। রঙকে নির্দেশ দিয়ে প্রভাবিত করা। রূপা মনে মনে বলল, লেমন ইয়েলো! তুমি আমার অতি প্রিয় একটা রঙ। আমি তোমাকে আমার কাগজে বিছিয়ে দিয়েছি। এখন তুমি আমাকে সাহায্য কর। তুমি তোমার ক্ষমতা দেখাও। কাগজের উপর সামান্য নাচ। ছোট্ট একটু ঢেউ উঠুক। অদ্ভুত কোনো ঘূর্ণি। বিচিত্র কোনো ডিজাইন।
আফা। আফা গো।
রূপা চোখ মেলল। মলিনা উত্তেজিত গলায় বলল, বিরাট ঘটনা ঘটে গেছে। আম্মা আসছে। গাড়িতে বসা। নামতে বলছি, নামব না। আপনারে যাইতে বলছে। রূপা একবার ভাবল বলে, এখন ছবি আঁকতে বসেছি যেতে পারব না। এই চিন্তা বাদ দিয়ে তাকে উঠে দাঁড়াতে হল। বড় কোনো ঘটনা নিশ্চয়ই ঘটেছে। কোনো কারণ ছাড়া তার মা গাড়ি নিয়ে ছুটে আসবেন না।
বিশাল পাজেরো গাড়ির পেছনের সিটে শায়লা বসা। তাঁকে ক্লান্ত এবং বিরক্ত দেখাচ্ছে। কফি কালারের চাদর দিয়ে শরীর এবং মাথা ঢেকে রেখেছেন। তার হাতে ইনহেলার। রূপাকে দেখে তিনি হাঁ করে ইনহেলার মুখের কাছে ধরলেন। দুবার চাপলেন। রূপা বলল, মা কি ব্যাপার?
শায়লা বললেন, গাড়িতে উঠে আয়।
এখন আমি কোথাও যাব না মা।
কোথাও যেতে হবে না। গাড়িতে উঠ। কথা বলব।
বাসায় এসো। সেখানে কথা বলব। গাড়িতে বসে কথা বলতে হবে কেন?
ঐ বাড়িতে আমি কখনো গিয়েছি? যাই নি, যাবও না। গাড়িতে উঠতে বলছি উঠে আয়। জরুরি কথা।
রূপা গাড়িতে উঠল। শায়লা ড্রাইভারকে বললেন, তুমি গাড়ি থেকে নাম। আমি মেয়ের সঙ্গে কিছু কথা বলব। তোমার শুনার প্রয়োজন নেই। তবে আশেপাশেই থাকবে। নিরুদ্দেশ হয়ে যেও না।
ড্রাইভার নেমে গেল। রূপা বলল, বল কি বলবে।
শায়লা বললেন, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখলাম, জীবন সঙ্গিনী চাই।
রূপা বলল, বিজ্ঞাপন বের হয়েছে? এত তাড়াতাড়ি?
তুই ব্যাপারটা জানতি?
জানতাম। ইনফ্যাক্ট বিজ্ঞাপনের কপি আমি লিখে দিয়েছি। প্রথম ড্রাফটটা বাবা লিখেছেন। যথারীতি কুৎসিত ছড়া দিয়ে শুরু–
জীবন সঙ্গিনী চাই
আর সময় নাই।
শায়লা বললেন, এই বয়সে এমন একটা হাস্যকর কাণ্ড তোর বাবা করল? তুই কিছু বললি না? তুই হয়ে গেলি তার এসোসিয়েট। কপি রাইটার?
রূপা বলল, হাস্যকর কোনো কাণ্ড বাবা করে নি। বাবা নিঃসঙ্গ একজন মানুষ। আমি চলে যাব ফ্রান্সে। বাবা আরো একা হয়ে যাবে, তখন তাকে কে দেখবে?
তুই ফ্রান্সে যাবি মানে কি?
ছবি আঁকা শেখার জন্যে যাব। একটা স্কলারশিপ পেয়েছি।
আমি তো কিছু জানলাম না।
এই তো জানলে।
শায়লা কিছু সময় চুপ করে থেকে বললেন, তোর বাবা বুড়ো বয়সে বিয়ের জন্যে পাগল হয়ে গেছে এটা তোর কাছে স্বাভাবিক মনে হচ্ছে?
রূপা বলল, তুমি যদি জোয়ান বয়সে আরেকটা বিয়ের জন্যে পাগল হতে পার তাহলে বাবার সমস্যা কি? অল্প বয়সে পাগল হওয়া যাবে বেশি বয়সে হওয়া যাবে না। এই তোমার যুক্তি?
আমাকে এখানে কেন টানছিস?
তোমাকে সব কিছুর বাইরে রাখব এটা কি করে ভাবছ? যাই হোক, বাবার বিয়ে নিয়ে অস্থির হয়ো না। শেষ পর্যন্ত বাবা বিয়ে করবে আমার তা মনে হয় না। কোনো কিছুতেই বাবার আগ্রহ বেশিদিন থাকে না। আর যদি বিয়ে হয় সেটা তোমার জন্যে ভাল হবে।
আমার জন্যে ভাল হবে কীভাবে?
বাবা তখন আর হুটহাট টেলিফোন করে তোমাকে বিরক্ত করবে না। ঝুড়ি ভর্তি মাছ-মাংস পাঠাবে না। জন্মদিন উপলক্ষে শাড়ি পাঠাবে না। তুমি ব্ৰিত হবে না। বাবা ব্যস্ত থাকবে ছোট মাকে নিয়ে।
ছোট মা?
রূপা হাসতে হাসতে বলল, তুমি আমার মা, উনি ছোট মা। নতুন মাও ডাকতে পারি। তোমার কোনটা পছন্দ? নতুন মা না-কি ছোট মা?
শায়লা বললেন, you hate me. তাই না?
রূপা বলল, না, তা না। তোমার ব্যাপারটা আমি বুঝিয়ে বলি। আমি সব মানুষের মধ্যে একটা রঙ দেখি। বাবার রঙ হচ্ছে কচি কলাপাতার রঙ। মলিনা মেয়েটা মেজেন্টা রাশেদ সাহেব লেমন ইয়েলো। তুমি গ্রে।
আমি গ্রে?
হুঁ। তবে রঙ নিয়ে মন খারাপ করো না। একজন ভাল পেইন্টার কিন্তু গ্রে কালার দিয়েও চমৎকার ছবি আঁকতে পারেন।