আপনি কি তাঁর মুগ্ধ হবার ক্ষমতা লক্ষ্য করেছেন? তার মুগ্ধতার ভিন্ন একটা মাত্রাও আছে— তিনি তাঁর নিজস্ব মুগ্ধতা ছড়িয়ে দিতে চান, যাতে তাঁর আনন্দের ভাগ অন্যরাও পায়। মুগ্ধ অনেকেই হয়। আনন্দ অনেকেই পায়। কিন্তু কজন তা ছড়িয়ে দিতে চায়?
অবশ্যই আপনি তাঁর সম্পর্কে এমন এক তথ্য জানেন— যা আমি জানি না। আমার জানার কথা নয়। সেই তথ্য জানিয়ে আপনি আমাকে যে ধাক্কাটি দিতে চেয়েছিলেন তা দিতে পেরেছেন। কী তীব্র কষ্ট যে আমি পেয়েছি তা আপনি কোনদিন জানবেন না। আপনি যদি ভেবে থাকেন— আমি কষ্ট পেয়েছি এই ভেবে যে আমি মানুষটিকে নিয়ে কখনো সংসার করতে পারব না। আমাদের ঘরে ছোট্ট বাবু আসবে না। তাহলে আপনি ভুল করেছেন। আপনি যদি ভেবে থাকেন কেন একদিন আমি মানুষটাকে আপনার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেব, তাহলে আপনি খুব বড় ভুল করেছেন। আমার বাবাকে একজন মার কাছ থেকে নিয়ে গেছে— মার কষ্ট আমি জানি। এই কষ্টের কোন সীমা নেই। আমি কি করে অন্যকে এই কষ্ট দেব? তা ছাড়া উনার মত মানুষকে ভুলানোর ক্ষমতা কি আমার মত বাচ্চা একটি মেয়েকে দেয়া হয়েছে?
আমার কষ্ট পাবার কারণ হল, যে মানুষ তার আনন্দ তার মুগ্ধতা চারদিকে ছড়িয়ে দেয় সে তার কষ্টটা কাউকেই বলতে পারে না। আমারতো মনে হয় নিজেকেও না। তাকে তার নিজের কষ্টও নিজের কাছ থেকে গোপন রাখতে হয়। মানসিক ভাবে সম্পূর্ণ একজন মানুষ শারীরিক অসম্পূর্ণতার জন্যে অসম্পূর্ণ। শরীর কি এতই বড়?
হ্যাঁ বড়। অবশ্যই বড়। শরীরের কাছে আমরা বার বার পরাজিত হই তারপরেও কিন্তু বলার চেষ্টা করি–শরীর কিছুই না। মনকে ধারণ করার সামান্য পাত্র মাত্র। মুখের বলায় কী যায় আসে। শরীর হচ্ছে শরীর। তার ক্ষমতাও মনের ক্ষমতার মতই অসীম।
আপনি উনাকে অসম্পূর্ণ শরীরের কারাগার থেকে মুক্তি দিতে চাচ্ছেন। উনি মুক্ত হতে চান সাহসের অভাবে পারছেন না। সেই সাহ আপনি উনাকে দিতে পারেন নি। আমি কিন্তু পারি। আপনি কি চান সেই সাহস আমি তাকে দেই?
রুমালী।
আমি চমকে তাকালাম। চিঠি তৈরিতে বাধা পড়ল। সোহরাব চাচা শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি বললাম, কী ব্যাপার চাচা?
সোহরাব চাচা নিচু গলায় বললেন–স্যার তোমাকে একটু ডাকছেন।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। সোহরাব চাচা প্রায় কান্না কান্না গলায় বললেন, স্যারের শরীরটা খুব খারাপ করেছে। মন খারাপ। শরীর খারাপ।
শুটিং বন্ধ হয়ে গেল সেই জন্যে মন খারাপ?
হ্যাঁ। কী কষ্ট যে স্যার করেন ছবির জন্যে। সেই ছবি যখন হয় না ….
সোহরাব চাচা?
জ্বি মা।
লক্ষ্য করেছেন বেশ অনেকদিন পর আপনি আমাকে মা বললেন।
সোহরাব চাচা চুপ করে রইলেন। আমি বললাম, আচ্ছা ঐ প্রসঙ্গ থাক। একটা জরুরি কথা বলি। আপনি আপনার স্যারকে এত পছন্দ করেন কেন?
জানি না মা।
সত্যি জানেন না?
না।
উনার কি জ্বর?
হ্যাঁ খুব জ্বর। তার উপর হাবিজাবি খেয়েছেন।
হাবিজাবিটা কী–মদ?
না মদ না–মন-ফল। চার পাঁচটা কোখেকে জোগাড় করে খেয়েছেন। মওলানা এনে দিয়েছে। শুনেছি এইসব খেলে পাগল হয়ে যায়।
আপনার কি ধারণা উনি পাগল হয়ে গেছেন?
আরে না। তবে চোখ লাল টকটকে হয়ে আছে দেখলে ভয় লাগে।
আমি হাসতে হাসতে বললাম, আমি ভয় পাব না। আমি খুব সাহসী মেয়ে। শুধু যে সাহসী তাই না–অন্যকে সাহস দেয়ার ব্যাপারেও এক্সপার্ট।
আমি খুব হাসছি। সোহরাব চাচা অবাক হয়ে তাকাচ্ছেন। আমিও নিজের কাণ্ড দেখে অবাক হচ্ছি— এত হাসছি কেন? আমি কি জাহেদা হয়ে যাচ্ছি?
উনার দরজার সামনে দাঁড়াতেই উনি বললেন–রুমালী এসো।
আমি পর্দা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম। সোহরাব চাচা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি জানি উনি যাবেন না। দাঁড়িয়ে থাকবেন। তাঁর স্যারের শরীর খারাপ, মন খারাপ। তিনি তাকে ছেড়ে এক পাও যাবেন না। প্রয়োজনে সারারাত দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবেন।
আমি ভেবেছিলাম উনাকে দেখব চাদর গায়ে বিছানায় শুয়ে আছেন। তা না। উনি চেয়ারে বসে আছেন। মনে হচ্ছে এখনই কোথাও বেরুবেন। ইলেকট্রিসিটি আছে। তারপরেও তাঁর সামনের টেবিলে মোমবাতি! ফুলদানী ভর্তি জবা ফুল। জবাফুল কেউ ফুলদানীতে সাজিয়ে রাখে না। তার ঘরে যতবার এসেছি জবা ফুল দেখেছি। জবা মনে হয় তার পছন্দের ফুল।
আপনি কি কোথাও যাচ্ছেন?
এখন যাচ্ছি না। যদি বৃষ্টি হয় নদীতে পানি আসে তাহলে পানি দেখতে যাব। শুটিং শেষ। সবাই চলে যাবে। এখন যদি নদী না দেখা হয় আর দেখা হবে না। শেষ সুযোগ। বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে না?
জ্বি পড়ছে। ফোঁটা ফোঁটা পড়ছে।
তুমি বোস। দাঁড়িয়ে আছ কেন?
আমি বসলাম। তিনি সিগারেট ধরালেন। ডুয়ার খুলে রুমাল নিয়ে পকেটে ভরলেন। চুল আঁচড়াতে লাগলেন। আশ্চর্য তাকে আজ খুব সুন্দর লাগছে। চোখ ঝকমক করছে। মানুষের সৌন্দর্যের পুরোটাইতো তার চোখে। মন-ফল খেলে চোখ কি হীরের মত জ্বলে? আমি বললাম, আপনি দেখি একেবারে ফিটফাট বাবু হয়ে নদী দেখতে যাচ্ছেন।
তিনি বললেন, আমি যেমন নদী দেখব, নদীওতো আমাকে দেখবে। নদীও দেখুক যে আমি ফরম্যালি তার কাছে এসেছি। এলেবেলে ভাবে আসি নি। যাই হোক তোমাকে ডাকার কারণ হচ্ছে তোমাকে একটা কথা বলা কথাটা না বললে আমার খারাপ লাগবে।
আপনি এমন ভাব করেছেন— যেন আর কোনদিন আপনার সঙ্গে আমার দেখা হবে না।
তোমার ধারণা দেখা হবে?
হ্যাঁ হবে। কারণ আপনি আবারো এই ছবি শুরু করবেন। তখন বিলু চরিত্র করার জন্যে আমাকে ডাকবেন।